রাস উৎসব সত্যিকার অর্থে রস উৎসব, রসের উৎসব। তৈত্তিরীয় উপনিষদে বলা হয়েছে ‘তিনি (শ্রীকৃষ্ণ) প্রকৃতপক্ষে রস। রস বলতে সার বা মূলকে বোঝায়। এই রসলীলা বা রাসলীলা হলো বৃন্দাবনে গোপিনীদের সঙ্গে রাধাকৃষ্ণের আরাধনা। এটি মূলত বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীদের উৎসব। বৈষ্ণবীয় ভাবধারায় শ্রীকৃষ্ণের প্রেম-প্রকৃতির উৎসবই হলো রাস।
গোপিনীরা ছিলেন কৃষ্ণপ্রেমে মুগ্ধ। তারা সংসার পরিত্যাগ করে বৃন্দাবনে সমবেত হয়েছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ তাদের সংসারে ফিরে যেতে অনুরোধ করেন। তারা যেতে অস্বীকার করেন। মনের দুঃখে শ্রীকৃষ্ণ রাধাকে নিয়ে চলে যান। এতে ভুল ভাঙে গোপিনীদের। নিজের অহঙ্কার ভুলে গিয়ে গোপিনীরা শ্রীকৃষ্ণের স্তব শুরু করেন। এতে সন্তুষ্ট হয়ে শ্রীকৃষ্ণ ফিরে আসেন এবং গোপিনীদের জীবনের পরমার্থ বোঝান। প্রত্যেক গোপিনীর মনোবাঞ্ছা পূরণ করে শ্রীকৃষ্ণ তাদের জাগতিক ক্লেশ থেকে মুক্তি দেন।
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে রাখালনৃত্যের মধ্য দিয়ে মনিপুরি সম্প্রদায়ের বৃহত্তম ধর্মীয় ও ঐতিহ্যবাহী মহারাসলীলা উৎসব শুরু হয়েছে। গতকাল শুক্রবার দুপুরে উপজেলার মাধবপুরের শিববাজার উন্মুক্ত মঞ্চে ঢাক-ঢোল, খোল-করতাল আর শঙ্খধ্বনির মধ্য দিয়ে শ্রীকৃষ্ণ ও তার সখী রাধার লীলাকে ঘিরে এ উৎসব শুরু হয়। এদিন রাত সাড়ে ১১টায় জোড়া মণ্ডপে অনুষ্ঠিত হয় রাসের মূল প্রাণ মহারাসলীলা। এই রাসনৃত্য ভোর পর্যন্ত চলে। রাসনৃত্যে গোপীদের সঙ্গে কৃষ্ণের মধুর লীলাই কথা, গানে ও সুরে ফুটিয়ে তোলেন শিল্পীরা।
এবার মাধবপুর জোড়া মণ্ডপে ১৮২তম রাস উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এদিকে কমলগঞ্জের আদমপুরে মনিপুরি মৈতৈ সম্প্রদায়ের আয়োজনে ৪২তম রাসোৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে। রাসোৎসবে মনিপুরি সম্প্রদায়ের লোকজনের পাশাপাশি বিদেশি পর্যটকসহ হাজার হাজার মানুষ অংশ নিচ্ছে।
মহারাত্রির আনন্দের পরশ পেতে সমাগত হয়েছেন নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক,
দেশি-বিদেশি পর্যটকসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তাদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠছে মাধবপুর ও আদমপুরের মণ্ডপ প্রাঙ্গণ। রাস উৎসব ঘিরে মাধবপুর ও আদমপুরের মণ্ডপগুলো সাজানো হয়েছে সাদা কাগজের নকশার নিপুণ কারুকাজে। করা হয়েছে আলোকসজ্জাও। এই উৎসব মনিপুরিদের সংস্কৃতির এক বিশাল মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে।
সরেজমিন দেখা যায়, গতকাল দুপুরে রাখালনৃত্যের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে রাস উৎসব। মহারাসলীলা উপলক্ষে উপজেলার মাধবপুর ইউনিয়নের শিববাজার জোড়া মণ্ডপ মহারাসলীলা দেখতে সারা দেশ থেকে আসা দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখর মণিপুরি পাড়াগুলো। রং-বেরঙের পোশাক আর বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজে উৎসবের জানান দিচ্ছে সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে। রাস উৎসব উপলক্ষে মণিপুরি তাঁতবস্ত্র প্রদর্শনী ও মেলা বসেছে। এ ছাড়া শান্তিপূর্ণভাবে উৎসব পালন করতে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
মহারাসলীলা সেবা সংঘের সাধারণ সম্পাদক শ্যাম সিংহ বলেন, রাস উৎসব শুধু মণিপুরিদের জন্য নয়, রাস দেখতে সারা দেশ থেকে হাজার হাজার দর্শনার্থী আসেন। এই উৎসবকে ঘিরে মণিপুরি প্রতিটা পরিবারে এক মাস ধরে প্রস্তুতি গ্রহণ করে।