সরকার পতনের লক্ষ্যে একদফা দাবিতে বিএনপির চলমান চূড়ান্ত আন্দোলনের কর্মসূচির নানা বিষয় চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। নিজেদের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে নেতারা আগামীতে আরও সতর্কভাবে পথ চলতে চান। একই রকম ভুল যেন আর না হয়, সেদিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সেইসঙ্গে সাম্প্রতিক কর্মসূচিতে দলটির যেসব নেতাকর্মী ফাঁকিবাজি করেছেন কিংবা শিথিলতা দেখিয়েছেন, তাদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। বিশেষ করে বিএনপির মূল শক্তি ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের শীর্ষ নেতাদের ওপর নাখোশ বিএনপির হাইকমান্ড। এরই মধ্যে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলামের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। গত বুধবার যুবদল ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণের কমিটি বিলুপ্ত করে নতুন কমিটি দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনাকে বলা হচ্ছে সতর্কবার্তা। পর্যায়ক্রমে অন্যদের কর্মকাণ্ড মূল্যায়ন করা হবে।
গত ২৯ জুলাই ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচিতে সমন্বয়হীনতার কারণে নেতাকর্মীর সর্বাত্মক উপস্থিতি নিশ্চিত না হওয়ায় নড়েচড়ে বসেছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। তারা ঢাকা মহানগর বিএনপির সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। এক্ষেত্রে মহানগর উত্তর বিএনপির কমিটি ভেঙে নতুনভাবে গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে। কর্মসূচি সফলে ব্যর্থ নেতারা পদ হারানোর আতঙ্কে আছেন। ওইদিনের কর্মসূচি ঘিরে যেসব নেতা দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন, তাদের নিয়ে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। কাউকে সাইড লাইনে বসিয়ে দেওয়া হতে পারে। ওই কর্মসূচির পর সহযোগী সংগঠনগুলোর সঙ্গে এক ভার্চুয়াল বৈঠকে কর্মসূচি সফল করার জন্য ‘দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের অনুপস্থিতি ও সমন্বয়হীনতা’ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিজেই। এমনকি দেশের বাইরে থাকা স্থায়ী কমিটির একজন সদস্যের কর্মসূচির সমন্বয়কের দায়িত্বে থাকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, অবিলম্বে আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপির আন্দোলন খুব দ্রুত গতিতে এগোচ্ছিল। একদফা দাবিতে চূড়ান্ত আন্দোলনের গতিতে বেশ জোয়ার এসেছিল। স্বল্প সময়ের নোটিশে গত ১২ জুলাই ঢাকার নয়াপল্টনে সমাবেশ করে বিএনপি। সেখান থেকে গত ১৮ ও ১৯ জুলাই রাজধানীতে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ পদযাত্রা কর্মসূচি করেছে তারা। এরপর গত ২২ জুলাই রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তারুণ্যের সমাবেশ এবং ২৮ জুলাই নয়াপল্টনে মহাসমাবেশ করে দলটি। বিএনপি নেতারা মনে করছেন, কমবেশি সব কর্মসূচিতেই লোকসমাগম ছিল আশানুরূপ। এসব কর্মসূচিতে দলীয় নেতাকর্মী ছাড়াও সাধারণ মানুষের উপস্থিতিও ছিল চোখে পড়ার মতো। তবে ২৯ জুলাই ঢাকার প্রবেশপথে অবস্থান কর্মসূচি নিয়ে চলছে নানামুখী সমালোচনা।
বিএনপি এবং অন্যান্য সূত্রের দাবি—কারও সঙ্গে পরামর্শ না করে দলেরই শীর্ষ কোনো নেতা ঢাকার প্রবেশপথে অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা করিয়েছেন, যা মাঠের নেতাকর্মী ও ঢাকার বাইরের নেতাকর্মীরা ভালোভাবে নেননি। তাদের অভিযোগ, পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সরকারদলীয় লোকজনের নানামুখী হয়রানির কারণে ঢাকায় ঠিকমতো অবস্থান করতে পারেননি। তবুও তারা ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করে ঢাকায় তিন দিন ধরে ছিলেন। ২৮ জুলাই মহাসমাবেশের শেষ পর্যায়ে যখন ঢাকার প্রবেশপথে অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা করা হয় ততক্ষণে ঢাকার বাইরে থেকে আসা নেতাকর্মীরা ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। অনেকটা বাধ্য হয়েই কিছু নেতাকর্মী সেদিন রাজধানীতে অবস্থান করেছিলেন এবং পরদিন ঢাকার প্রবেশপথে অবস্থান কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন। তবে মহানগরীর নেতাকর্মীদের উপস্থিতি দেখতে না পেয়ে তারা কিছুটা হতাশ হন। বিএনপির অঙ্গসংগঠন ও মহানগরীর নেতাকর্মীদের কর্মকাণ্ডে তারা খুশি হতে পারেননি। ওই কর্মসূচি ঘিরে পুলিশের সঙ্গে নেতাকর্মীর সংঘর্ষের ঘটনায় নতুন মামলা এবং গ্রেপ্তারে হঠাৎ চাপে পড়ে বিএনপি। এর পরই আন্দোলনে ভাটার টান লাগে। ৩১ জুলাই জেলা ও মহানগরে প্রতিবাদ সমাবেশের কর্মসূচির মধ্য দিয়ে নেতাকর্মীকে নিজ জেলায় ফেরত পাঠানো হয়।
***তিন সংগঠনের প্রতি নাখোশ হাইকমান্ড
তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের কর্মকাণ্ডের প্রতি নাখোশ বিএনপির হাইকমান্ড। এরই মধ্যে গত মঙ্গলবার ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণকে অসুস্থতা দেখিয়ে দলীয় পদ থেকে কার্যত সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং সিনিয়র সহসভাপতির বিরুদ্ধেও দায়িত্ব পালনে অবহেলার অভিযোগ উঠেছে। যুবদলের শীর্ষ নেতারাও অভিযুক্ত হচ্ছেন। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় নেতাদের যারা নিষ্ক্রিয় ছিলেন, তারা শাস্তির মুখে পড়তে পারেন।
দলটির নেতারা জানান, গত ২৯ জুলাই ঢাকার পাঁচটি প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচিতে সমন্বয়হীনতার কারণে নেতাকর্মীর সর্বাত্মক উপস্থিতি নিশ্চিত করা যায়নি। অথচ ওই তিন সংগঠন এবং মহানগর বিএনপির নেতারা সর্বোচ্চসংখ্যক নেতাকর্মী জমায়েতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে।
ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সংগঠনের ভেতরে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও গ্রুপিং দীর্ঘদিনের। সেই কোন্দল নিরসনের লক্ষ্যে ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি রকিবুল ইসলাম বকুলকে বিএনপির কেন্দ্রীয় ছাত্রবিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি দায়িত্ব পাওয়ার পর ছাত্রদলের দ্বন্দ্ব-গ্রুপিং নিরসনে একাধিক উদ্যোগ নিলেও তা পুরোপুরি সফল হয়নি। ছাত্রদলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক (শ্রাবণ-জুয়েল) নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে গেলে ওই গ্রুপিং আরও সক্রিয় হয়েছে। সরকারবিরোধী চলমান আন্দোলনে যার বিরূপ প্রভাব দেখা দেয়। এ ছাড়া গত ২ আগস্ট বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও তার স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমানকে সাজা দেওয়ার ঘটনায় নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ মিছিলেও মারামারির ঘটনা ঘটে। গত ২৯ জুলাই ঢাকার প্রবেশপথে বিএনপির অবস্থান কর্মসূচিতেও ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা সেভাবে নামেননি। এ জন্য সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সাংগঠনিক ব্যর্থতাকে দায়ী করা হয়। তা ছাড়া ছাত্রদল সভাপতির ওইদিন ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের উত্তরা এলাকায় থাকার কথা ছিল। তিনি সেখানে না যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। বরং বিকেলের দিকে তিনি খিলক্ষেতে ঝটিকা মিছিলের ভিডিও ভাইরাল করেন। বিএনপির অবস্থান কর্মসূচিতে দায়িত্বে অবহেলার কারণেই মূলত শ্রাবণের বিরুদ্ধে এই সাংগঠনিক ব্যবস্থা বলে দাবি অনেকের। যদিও ছাত্রদল সভাপতিকে এভাবে সরিয়ে দেওয়াটা ভালোভাবে নেননি অনেকে। এ ঘটনায় ছাত্রদলে সংকট আরও বাড়বে।
সূত্র জানায়, যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর মাতুয়াইলে অবস্থান কর্মসূচি চলাকালে দৌড়ে পালানোর একটি ভিডিও ভাইরাল হলে তা নিয়েও অন্য নেতাকর্মী এবং বিএনপির হাইকমান্ড বিব্রত হয়েছে। অন্যদিকে স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং সিনিয়র সহসভাপতিও নির্ধারিত স্পটে সময়মতো না যাওয়ায় বিএনপির হাইকমান্ড ক্ষুব্ধ হয়েছে। সার্বিক বিবেচনায় যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের শীর্ষ নেতৃত্বেও পর্যায়ক্রমে পরিবর্তন আসতে পারে বলে সূত্রের দাবি।
অবস্থান কর্মসূচিতে সাফল্য না আসা এবং আন্দোলনে গতি না আনতে পারায় ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির বর্তমান কমিটি ভেঙে দিয়ে নতুন কমিটির গঠনের চিন্তা করছে বিএনপির হাইকমান্ড। এরই মধ্যে কয়েকজন সম্ভাব্য নেতার সঙ্গে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান কথা বলে খোঁজখবরও নিয়েছেন। যে কোনো সময় তিনি নতুন সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেবেন। তবে নেতাদের আশা, বিষয়টি এবার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নজরে আসা এবং দল থেকে কড়া সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার ইঙ্গিতে তাদের ভবিষ্যৎ কর্মসূচিগুলো আরও সুসংগঠিত হবে এবং তাতে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের অংশগ্রহণও বাড়বে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, নেতার আদর্শ, উদ্দেশ্য ও প্রয়োজনে দুঃসাহস না থাকলে সে নেতৃত্ব দিতে পারে না। নেতা সঠিক অবস্থানে না থাকলে কর্মীদের পক্ষে কাজ করা সম্ভব নয়। কঠিন সময়ে নেতার নেতৃত্ব চেনা যায়। বর্তমানে কঠিন সময়ে যারা সাহসিকতার সঙ্গে সামনে থাকবে, তারাই হবে প্রকৃত নেতা; বিএনপির আগামী দিনের কাণ্ডারি।
মন্তব্য করুন