চালু হওয়ার দীর্ঘ দুই বছর পর কোম্পানি পর্যায়ে গ্যাস কেনাবেচায় মিটারিং পদ্ধতির অনুমোদন দিয়েছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। পাশাপাশি আনুপাতিক হারে (প্রো-রাটা) বিল করার পদ্ধতি বাতিল করা হয়েছে। এখন থেকে গ্যাস উৎপাদন, সঞ্চালন, বিতরণ ও বিপণনের সব পর্যায়ে মিটারিং ব্যবস্থা বাস্তবায়ন হবে। ফলে অপচয় ও চুরি কমে আসবে এবং কোম্পানি ভেদে সিস্টেম লসের প্রকৃত চিত্র জানা যাবে। দুই বছর ধরে পেট্রোবাংলা মিটারিং পদ্ধতি বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করলেও গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (জিটিসিএল) বিরোধিতার কারণে সব কোম্পানির ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করা যায়নি। জ্বালানি বিভাগ ও পেট্রোবাংলার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ তথ্য জানান।
সংশ্লিষ্টরা জানান, মিটারিং ব্যবস্থা বাস্তবায়নের আগে দেশের একমাত্র গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি জিটিসিএল পরিমাপ করে গ্যাস নিলেও বিতরণ কোম্পানিগুলোর কাছে সরবরাহের সময় পরিমাপের ব্যবস্থা ছিল না। নতুন ব্যবস্থায় সব স্তরে মিটারিং পদ্ধতি চালু করার কথা বলা হয়েছে। এখন থেকে জিটিসিএল যেভাবে মিটার অনুযায়ী গ্যাস বুঝে নিচ্ছে, তেমনি মিটারের মাধ্যমে বিতরণ কোম্পানিকে বুঝিয়ে দেবে।
গত সোমবার জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের উপসচিব মো. শেখ শহিদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত চিঠিতে ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে মিটারিং পদ্ধতিকে ভূতাপেক্ষ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানের কাছে নির্দেশনার এ চিঠি পাঠানো হয়েছে।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, গ্যাস উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণের সব স্তরে শতভাগ মিটারিং ব্যবস্থা কার্যকরের নিমিত্তে পেট্রোবাংলা গৃহীত গ্যাসের উৎপাদন থেকে শুরু করে গ্রাহক প্রান্তে পৌঁছে দেওয়ার সরবরাহ চেইনের সব পর্যায়ে প্রকৃত মিটারিং ব্যবস্থা বাস্তবায়নের কার্যক্রমটি ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ভূতাপেক্ষভাবে অনুমোদন দেওয়া হলো। মিটারিং ব্যবস্থা কার্যক্রমের সঙ্গে একাধিক স্টেকহোল্ডার জড়িত থাকায় মিটারিং ব্যবস্থার পরিবীক্ষণ, ক্যালিব্রেশন, রিডিং গ্রহণ ইত্যাদি সংক্রান্ত কার্যক্রম পেট্রোবাংলা সমন্বয় করবে।
কোম্পানিগুলোর সিস্টেম লস কমানোর নির্দেশনা দিয়ে চিঠিতে বলা হয়েছে, অবৈধ সংযোগ, লিকেজ ও গ্যাস চুরি বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে যে পরিমাণ সিস্টেম লস হয়, তা চিহ্নিত করে এর সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। একই সঙ্গে সিস্টেম লস হ্রাসে যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী ইতিবাচক ভূমিকা রাখবেন, তাদের মূল্যায়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ছাড়া সিস্টেম লসের প্রকৃত পরিমাণ পরিমাপ করে কোম্পানিগুলো সার্ভিস এলাকাকে বিভিন্ন জোনে বিভক্তপূর্বক মাসভিত্তিক সিস্টেম লস কমানোর পরিকল্পনা প্রণয়ন করবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী কোম্পানিগুলো তা বাস্তবায়ন করে মাসভিত্তিক প্রতিবেদন পেট্রোবাংলার মাধ্যমে জ্বালানি বিভাগে প্রেরণ করতে হবে।
পাশাপাশি মিটারিং পদ্ধতি চালু হওয়া জিটিসিএলের আর্থিক লোকসান থেকে উত্তরণের জন্য চিঠিতে চারটি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পেট্রোবাংলার সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার গত সপ্তাহে এ বিষয়ে কালবেলাকে বলেন, গ্যাস কেনাবেচার সব পর্যায়ে মিটারিং পদ্ধতি চালু করা গেলে গ্যাস খাতে স্বচ্ছতা বাড়বে। অপচয় ও চুরি কমবে। আর অপচয়ের দায় কার, সেটি নির্ধারণ করা যাবে।
পেট্রোবাংলার এক কর্মকর্তা জানান, এতদিন জিটিসিএল সিস্টেম লস অন্য কোম্পানির কাঁধে সরিয়ে দিয়ে বিপুল পরিমাণ মুনাফা করেছে। একই সঙ্গে পরিমাণ বেশি হওয়ায় সঞ্চালন চার্জ বেশি আদায় করেছে। সেই মুনাফার পাহাড় থেকে প্রতি বছর ২ থেকে ৬ লাখ টাকা পর্যন্ত প্রফিট বোনাস নেন জিটিসিএলের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। পেট্রোবাংলা সরবরাহ পর্যায়ে মিটার বসিয়ে পরিমাপ পদ্ধতি চালু প্রক্রিয়া শুরু করলে সাবেক চেয়ারম্যানের (জনেন্দ্র নাথ সরকার) সঙ্গে টানাপোড়েন শুরু হয়। এমনকি পেট্রোবাংলার সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগও করে জিটিসিএল।
ওই কর্মকর্তা জানান, জিটিসিএল অফ-ট্রান্সমিশন পয়েন্টের মাধ্যমে বিতরণ কোম্পানিগুলোতে গ্যাস সরবরাহ করলেও বেশিরভাগ অফ-ট্রান্সমিশন পয়েন্টে সরাসরি গ্যাস মিটারিং না থাকায় জিটিসিএলের ট্রান্সমিশন সিস্টেমে কারিগরি বা অন্যভাবে গ্যাসের কোনো পার্থক্য নির্ণয় করা সম্ভব ছিল না। এতে বিতরণ কোম্পানিগুলোর পক্ষে প্রকৃত ক্রয়ের পরিমাণ নিরূপণ করা সম্ভব হতো না ও ট্রান্সমিশন সিস্টেমের লোকসান কিংবা পার্থক্য বিতরণ কোম্পানির নিজস্ব পার্থক্যের সঙ্গে একীভূত হয়ে যেত। বর্তমান প্রবর্তিত পদ্ধতিতে গ্যাস উৎপাদন কোম্পানি, আইওসি এবং আরএলএনজি উৎসসমূহ থেকে মোট ২০টি পয়েন্টে মিটারিংয়ের মাধ্যমে গ্যাস গ্রহণ করছে এবং ৬৪টি
অফ-ট্রান্সমিশন পয়েন্টের মাধ্যমে বিতরণ কোম্পানিগুলোতে সরবরাহ করছে।
মিটার বসানোর পর পেট্রোবাংলার তৈরি করা গ্যাসের সঞ্চালন ও বিতরণ কোম্পানিগুলো কেনাবেচার একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে জিটিসিএলের সিস্টেম লস ২ দশমিক ৯৫ শতাংশ, ফেব্রুয়ারিতে ২ দশমিক ৯৯ শতাংশ, মার্চে ৩ দশমিক ১০ শতাংশ এবং এপ্রিলে ২ দশমিক ৪১ শতাংশ। অন্যদিকে মিটার অনুযায়ী মার্চে (২০২৩) তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ১০ দশমিক ৭৮ শতাংশ, বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ, জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ১ দশমিক ৩৪ শতাংশ, কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ২ দশমিক ০৫ শতাশ লোকসান হয়েছে। ছয়টি বিতরণ কোম্পানির ১৬১ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস লোকসান ছিল।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) ২০২২ সালের এক আদেশে বলেছে, গ্যাসের সিস্টেম লস কোনো অবস্থাতেই ২ শতাংশের বেশি গ্রহণযোগ্য হবে না। এর নিচে নামিয়ে আনতে হবে। বিশ্বের কোথাও ২ শতাংশের বেশি সিস্টেম লস নেই। কিন্তু এতদিন নানা রকম ফাঁকফোকর দিয়ে চুরি হওয়া গ্যাসকে সিস্টেম লস বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছিল।