রাজধানীর ব্যস্ত সড়ক বেইলি রোড। বছরভর জনসমাগমে মুখর থাকে এই সড়ক। অনেকে শপিংয়ের জন্য এখানে আসেন। ভোজনরসিকদের অন্যতম গন্তব্যও বটে। গত বছরের ২৯ ফেব্রুয়ারি বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ঝরে যায় ৪৬ প্রাণ। ওই অগ্নিকাণ্ডের পর বেইলি রোডসহ রাজধানীজুড়ে রাজউক ও সিটি করপোরেশনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যৌথ অভিযানে ঝুঁকিপূর্ণ রেস্টুরেন্ট চিহ্নিত করে সিলগালা ও জরিমানা করা হয়। যথারীতি ভাটা নামে অভিযানে। সব আবার চলতে শুরু করেছে।
এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই বেইলি রোডও। ভয়াবহ সেই অগ্নিকাণ্ডের এক বছর পর সেখানে আগের মতোই জমজমাট সব ঝুঁকিপূর্ণ রেস্টুরেন্ট ও রেস্তোরাঁ। সিলগালা রেস্টুরেন্টগুলোর তালা খুলেছে। শিগগির মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হবে, বলছে রাজউক।
অন্যদিকে ৪৬ মৃত্যুর মামলার তদন্ত চলছে। গ্রেপ্তার আসামিরা জামিন পেয়েছেন। গতকাল বিকেলে সরেজমিন বেইলি রোড ঘুরে দেখা যায়, গ্রিন কোজি কটেজের পোড়া ভবনটি আজও সেই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের স্মারক বহন করে চলেছে। আর পোড়া ভবনটির গা-ঘেঁষে নির্মিত আরেকটি ভবন নানা আলোয় সুসজ্জিত। এই ভবনে রয়েছে পিৎজা হাট, সিক্রেট রেসিপি ও কেএফসি। অগ্নিকাণ্ডের পর অভিযানের কারণে কিছুদিন এসব রেস্টুরেন্ট বন্ধ থাকলেও এখন চলছে রমরমিয়ে। রমজান ঘিরে নানা আয়োজনে ব্যস্ত রেস্তোরাঁগুলো।
গত বছর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর পর্যাপ্ত অগ্নিনিরাপত্তা না থাকাসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে নবাবী ভোজ, সুলতানস ডাইন, চিলক্সসহ বেইলি রোডের বেশকিছু রেস্টুরেন্ট ও রেস্তোরাঁ সিলগালা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত । সিলগালার কিছুদিন পরই ঝুঁকি নিয়ে আবার চালু হয় রেস্টুরেন্টগুলো।
পোড়া গ্রিন কোজি কটেজের পাশে কয়েকটি ভবনের পরের একটি চারতলা দালানের দুই ও তিন তালায় সুলতানস ডাইন। রেস্টুরেন্টের সিঁড়ি আগের মতোই সরু। ভবনটির নিচতলায় শাহী মামা পেঁয়াজু নামের এক রেস্তোরাঁয় তৈরি হচ্ছে পেঁয়াজু, শিঙাড়াসহ রকমারি মুখরোচক খাবার। গ্যাস সিলিন্ডার ঝুঁকিপূর্ণভাবে আগুনের পাশে রাখা। এই দোকানের কর্মচারী উজ্জ্বল বলেন, আগুন লাগার পর আশপাশে প্রায় সব রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এখন পোড়া ভবন বাদে সব রেস্টুরেন্টে চালু হয়েছে।
চালু হয়েছে সিলগালা থাকা নবাবী ভোজের দুটি আউটলেটও। নবাবী ভোজ-১ আউটলেটের একজন কর্মচারী বলেন, অনেক রেস্টুরেন্টই ওই সময় বন্ধ করা হয়েছিল। এখন সবই চলছে। রমজানে আমাদের এখানে বিশেষ আয়োজন থাকছে।
পোড়া গ্রিন কোজি কটেজের পাশের পাঁচতালা ভবনে রয়েছে বার্গার এক্সপ্রেস নামে আরেকটি রেস্টুরেন্ট। নিরাপদে যাওয়া আসার ব্যবস্থা না থাকাসহ আইন লঙ্ঘনের কারণে এটি বন্ধ করা হয়। দিন কয়েক পর লোহার একটি ইমার্জেন্সি সিঁড়ি তৈরি করে চালু করা হয়েছে রেস্টুরেন্টটি। দৃশ্যত এ সিঁড়ি তৈরি করা হলেও বন্ধই থাকে। আগের সরু সিঁড়িই ব্যবহার হচ্ছে। এ রেস্টুরেন্টের নিচতলায় মি. বেকার, এ ওয়ান ফুড, আল আরাবিয়ান কেক অ্যান্ড সুইটস, হট কেক, সিটি ফ্রুট জুস বার রয়েছে। ওপরে পিৎজা অ্যান্ড রাইস, ওয়াসিস ক্যাফে অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট রয়েছে। এসব রেস্টুরেন্টের জন্য আছে একটি মাত্র সরু সিঁড়ি।
শান্তি নগর মোড়ের একটি ভবনের নিচতলাজুড়ে রয়েছে কয়েকটি ছোট্ট ফাস্টফুডের দোকান। এগুলোর সবই ব্যবসা করছে ঝুঁকি নিয়ে। এর মধ্যে ফিশ কেক, ফাইভ স্টার, জাফরান জুস বার, কফি লাইনে খাবার তৈরি হচ্ছে আগুনের পাশে গ্যাস সিলিন্ডার রেখে। আরেকটি দোকানের নাম হক টাঙ্গাইল চমচম ও দধি, এখানে দই-মিষ্টির বদলে বিক্রি হচ্ছে তেলে ভাজা মোগলাইসহ রকমারি ফাস্টফুড। এখানেও আগুনের পাশে রাখা হয়েছে গ্যাস সিলিন্ডার। দোকানটির কর্মচারী ভবেশ বলেন, অভিযানের সময় অনেক দোকান বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু গ্যাস সিলিন্ডার কি বন্ধ হয়। এখন কোনো সমস্যা নেই। অভিযানের সময় বেইলি ডেলিকে ২ লাখ, ভূতের আড্ডাকে ১ লাখ, সুইস বেকারিকে ১ লাখ এবং ম্যাড শেফকে ১ লাখ টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এসব রেস্টুরেন্টসহ ১২ রেস্তোরাঁ ও কফিশফের লাইসেন্স বাতিল করতে রাজউক থেকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে চিঠি পাঠানো হয়েছে। এসব রেস্টুরেন্ট বা রেস্তোরাঁ আগের মতোই চলছে রমরমিয়ে।
রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম বলেন, সিলগালা রেস্টুরেন্ট-রেস্তোরাঁ আদালতের আদেশ নিয়ে খুলেছে। দু-তিন দিন আগে একটি সভা করা হয়েছে। শিগগির রাজউকের নেতৃত্বে ফায়ার সার্ভিস ও বিদ্যুৎ বিভাগকে নিয়ে আবার অভিযান পরিচালনা করা হবে। মোবাইল কোর্ট হবে। সচেতনতা বাড়াতে পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞপ্তিসহ লিফলেট বিতরণ করা হবে।
৪৬ মৃত্যুর মামলা আটকা তদন্তে : ২০২৪ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি রাত পৌনে ১০টার দিকে বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজে আগুন লাগে। জীবিত উদ্ধার করা হয় ৭৫ জনকে। মারা যান ৪৬ জন। তাদের মধ্যে পুরুষ ২০, নারী ১৮ ও শিশু ৮ জন। এ ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগে রমনা মডেল থানায় উপপরিদর্শক মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম একটি মামলা করেন। মামলাটি প্রথমে রমনা থানা তদন্ত করলেও বর্তমানে রয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কাছে। তদন্ত শেষ না হওয়ায় আটবার তারিখ পরিবর্তন করা হয়েছে। ১১ মার্চ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের পরবর্তী দিন ধার্য রয়েছে।
মামলার পর গ্রেপ্তার হন ৮ জন। তবে তারা সবাই এখন জামিনে আছেন। আসামিরা হলেন—কাচ্চি ভাই রেস্তোরাঁর মালিক সোহেল সিরাজ, গ্রিন কোজি কটেজ ভবনের নিচতলার ‘চুমুক’-এর দুই মালিক আনোয়ারুল হক ও শফিকুর রহমান রিমন, বিরিয়ানি রেস্তোরাঁ ‘কাচ্চি ভাই’ বেইলি রোড শাখার কর্মকর্তা জেইন উদ্দিন জিসান, ফুকো চেইন রেস্টুরেন্টের আব্দুল্লাহ আল মতিন, মোহর আলী পলাশ এবং ভবনটির দেখভালের দায়িত্বে থাকা মুন্সী হাসিবুল আলম বিপুল।
তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডি পুলিশের ইন্সপেক্টর শাহজালাল মুন্সী বলেন, তদন্তের স্বার্থে সংশ্লিষ্ট অনেকের কাছে প্রয়োজনীয় নথি চাওয়া হয়েছে। যেমন—ভবন নির্মাণ ও অনুমোদনে কোনো ত্রুটি আছে কি না জানতে রাজউক ও আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের কাছে প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছে। তারা এখনো প্রতিবেদন দেয়নি। সেগুলো পেলে তদন্তের কাজ তাড়াতাড়ি হবে। ভবনটির নিচতলার ‘চা চুমুক’ দোকানের ইলেকট্রিক কেটলি থেকে আগুনের সূত্রপাত বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। ভবন মালিক বা দোকান মালিকের অবহেলা বা ভূমিকা বোঝা যাবে তদন্ত শেষে।
সৈয়দ মোবারক কাউসারসহ একই পরিবারের পাঁচজন মারা যান ওই অগ্নিকাণ্ডে। পরিবারটির সদস্য আমীর হামজা বলেন, আমরা সঠিক বিচার চাই। যা ক্ষতি হওয়ার হয়েছে। আর যেন এ ধরনের ঘটনা না ঘটে, সেজন্য দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা হওয়া প্রয়োজন। না হলে, এ ধরনের ঘটনা আরও ঘটবে।
এদিকে আসামি ফুকো চেইন রেস্টুরেন্টের আব্দুল্লাহ আল মতিনের আইনজীবী অভিজিৎ কর্মকার বলেন, তার নাম এজাহারে ছিল না। এ ছাড়া মতিনের সঙ্গে কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টের কোনো সম্পর্ক নেই। ডিবি পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদেও কিছু পায়নি। তাকে শুধু শুধু মামলায় সম্পৃক্ত করা হয়েছে। সঠিক তদন্ত হলে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হবেন। কাচ্চি ভাই রেস্তোরাঁর মালিক সোহেল সিরাজের আইনজীবী তাহসিনা তাবাসসুম তরীর সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কয়েক দফা ফোন করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
মন্তব্য করুন