দেশে আবাসিক ভবন থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক কিংবা প্রতিষ্ঠান রয়েছে এমন ভবনেও যে ন্যূনতম অগ্নিনিরাপত্তা নেই, তা আগুন লাগার পর চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। সেই অগ্নিঝুঁকির মধ্যেই এবার ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগ মোকাবিলায় চিন্তিত দেশের ফায়ার ফাইটাররা (অগ্নিনির্বাপকরা)। এরই মধ্যে সম্প্রতি মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডে বড় মাত্রার ভূমিকম্প সেই চিন্তা আরও বাড়িয়েছে। তবে ভূমিকম্প বা অগ্নিদুর্ঘটনা, কিছুতেই প্রয়োজনীয় ফায়ার স্টেশন আর ফায়ার ফাইটারের অভাবে সময় মতো সাড়া দিতে পারছে না ফায়ার সার্ভিস। এতে ক্ষয়ক্ষতিও বাড়ছে। এমন নানা সংকটের মধ্যেই আজ ৪ মে পালিত হতে যাচ্ছে ‘ইন্টারন্যাশনাল ফায়ার ফাইটার্স ডে’। ফায়ার ফাইটারদের নিঃসার্থকতা, সাহসিকতা এবং নিষ্ঠার প্রতীক হিসেবে সম্মান জানাতে ১৯৯৮ সাল থেকে এই দিনটি পালিত হয়ে আসছে।
দেশে প্রয়োজনীয় ফায়ার স্টেশন বা জনসংখ্যার তুলনায় যে ফায়ার ফাইটার কম, তা ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, দুর্যোগ মোকাবিলায় তারা দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা প্রস্তুত থাকলেও প্রয়োজনীয় স্টেশন ও ফায়ার ফাইটারের সংকটে দ্রুততম সময়ে সেবা দিতে পারছেন না।
ফায়ার স্টেশনবিহীন এলাকায় উচ্চঝুঁকি: ফায়ার সার্ভিসের সমীক্ষা বলছে, রাজধানী ঢাকার কয়েকটি জনবহুল এলাকায় কোনো ফায়ার স্টেশনই নেই। এতে কোথাও আগুন লাগলে দূরের স্টেশন থেকে ঘটনাস্থলে যেতে বিলম্ব হয়, যার কারণে প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি বাড়িয়ে দেয়। মতিঝিল এলাকায় বাংলাদেশ ব্যাংক, মেট্রোরেল স্টেশন, শপিংমল ও বহুতল ভবনসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন স্থাপনা থাকলেও নেই কোনো ফায়ার স্টেশন। নিকটতম স্টেশনটির অবস্থানও ৩ কিলোমিটার দূরে পুরান ঢাকার সিদ্দিকবাজারে। যেখান থেকে যানজট এড়িয়ে মতিঝিল পৌঁছতে অনেক সময় লেগে যায়। শেরেবাংলা নগর ও আগারগাঁও এলাকার চিত্রও একই। সেখানে বাংলাদেশ বেতার, স্পারসো, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট, শিশু হাসপাতালসহ সরকারি-বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ নানা স্থাপনা থাকলেও নেই ফায়ার স্টেশন। এর নিকটতম ফায়ার স্টেশনও ৪ কিলোমিটার দূরে মোহাম্মদপুরে।
কারওয়ান বাজার ও বাংলামটর এলাকায় বিপণিবিতান ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান থাকলেও আড়াই কিলোমিটার দূরত্বের তেজগাঁও ফায়ার স্টেশন থেকে যানজট এড়িয়ে এই এলাকায় আসতে হয় আগুন নেভাতে। আদাবর-শ্যামলী এলাকায় নতুন নতুন আবাসিক ভবন ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও সেখানেও নেই ফায়ার স্টেশন। ৪ কিলোমিটার দূরের মোহাম্মদপুর ফায়ার স্টেশন থেকে যেতে হয় সেখানে।
এ ছাড়া গুলশান-বনানীতে কূটনৈতিক জোন ও আবাসিক এলাকা হলেও নিকটতম ফায়ার স্টেশনটিও ৩ কিলোমিটার দূরের বারিধারায়। যানজট এড়াতে বনানীতে ফায়ার ফাইটাররা সহায়তায় আসেন কুর্মিটোলা স্টেশন থেকে। ধানমন্ডিতে বিজিবি সদর দপ্তর, শপিংমল ও হাসপাতাল থাকলেও ফায়ার স্টেশন নেই। এখানেও ৩ থেকে ৪ কিলোমিটার দূরের মোহাম্মদপুর থেকে আসতে হয় ফায়ার ফাইটারদের। এ ছাড়া রামপুরা, যাত্রাবাড়ী, কামরাঙ্গীরচর ও বসুন্ধরা এলাকায়ও ফায়ার স্টেশন না থাকায় অগ্নিকাণ্ডের সময় দ্রুত সাড়া দিতে পারেন না ফায়ার ফাইটাররা।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল কালবেলাকে বলেন, ‘ফায়ার স্টেশনের সংখ্যা বাড়লে অবশ্যই আমাদের কাজের ক্ষেত্রে আরও অনেক সুবিধা হতো। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।’
তিনি বলেন, ‘একটি ফায়ার স্টেশন তৈরিতে কমপক্ষে এক একর জায়গা দরকার। কিন্তু বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সেই ফায়ার স্টেশনের দরকার হলেও জায়গার অভাবে সেটি করা যাচ্ছে না। এজন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে বিভিন্ন সময়ে আবেদন করা হয়েছে।’
অন্য দেশের সঙ্গে তুলনামূলক চিত্র: ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, দেশে ফায়ার সার্ভিস কর্মীর সংখ্যা মাত্র ১৪ হাজার ৫৭০ জন, যা দেশের মোট জনসংখ্যার অনুপাতে প্রতি ১১ হাজার ৯০৯ জনে মাত্র একজন। অন্যদিকে, মালয়েশিয়ায় প্রতি ২ হাজার ৫৯৭ জনে একজন, রাশিয়ায় ৫৩৮ জনে একজন, জাপানে ৭৫৬ জনে একজন এবং যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ৯০০ জনে একজন। যা বিশ্বের অন্যান্য শহরের তুলনায় ঢাকার জন্য উদ্বেগের বলে মনে করছেন দেশের ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা। ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকায় মাত্র ১৮টি ফায়ার স্টেশন রয়েছে, যেখানে টোকিও সিটিতে ২৯২টি, দিল্লিতে ৬৬টি, জাকার্তায় ১৫৪টি, বেইজিংয়ে ৩০৪টি এবং নিউইয়র্ক সিটিতে রয়েছে ২১৮টি ফায়ার স্টেশন।
ফায়ার স্টেশনের সংখ্যা কমের পাশাপাশি রাজধানী ঢাকায় ফায়ার ফাইটারের সংখ্যাও কম, যা মোট জনসংখ্যার অনুপাতে প্রতি ২৭ হাজার ৭৭৭ জনে মাত্র একজন। ঢাকার ফায়ার স্টেশনগুলোতে মাত্র ৬৩০ জনের মতো ফায়ার ফাইটার রয়েছেন। অথচ এই সংখ্যা দিল্লিতে ৩ হাজার ৬১৬, জাকার্তায় ২ হাজার ৫৭১ এবং তেহরানে ৫ হাজার ২৪৩।
এসব পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকা ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় সব জায়গায় দ্রুত যাওয়া সম্ভব হয় না। এ ক্ষেত্রে আগুন লাগার খবর পাওয়ার পর যেন কমপক্ষে ৫ মিনিটের মধ্যে পৌঁছানো যায়, সে হিসেবে এলাকাভিত্তিক ফায়ার স্টেশন থাকা উচিত। কিন্তু ঢাকায় তা নেই। এজন্য ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি থেকে যায়।
মন্তব্য করুন