

বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া প্রায় প্রতিটি মানুষই বাংলায় কথা বলে, কিন্তু সবাই যে শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলে তা নয়। অঞ্চল, পরিবার, সামাজিক পরিবেশ, এমনকি শিক্ষার ধরনভেদে আমাদের উচ্চারণে ব্যাপক পার্থক্য দেখা যায়।
কেউ বলে “স্কুল”, কেউ “ইশকুল”; কেউ বলে “তুমি করছো?”, কেউ বলে “করছিস?”, আবার কেউ বলে “তুমি কইরা ফালাইছো?”। প্রশ্ন উঠছে—এ দেশে জন্মিয়েও আমরা কেন নিজেদের ভাষার উচ্চারণে শুদ্ধ হতে পারছি না?
সমস্যার মূল কারণ হলো শিক্ষা পদ্ধতির অপ্রয়োগধর্মিতা। স্কুলে ধ্বনি, বর্ণ ও তত্ত্ব শেখানো হয়; কিন্তু কণ্ঠ, মুখ ও শব্দ উৎপাদনের অনুশীলন শেখানো হয় না। শিশুরা জানে “ত” আর “থ” আলাদা, জিহ্বা কোথা থেকে নড়বে তা শেখানো হয় ঠিকই, কিন্তু কণ্ঠ কীভাবে কম্পিত হবে তা ডেমোনস্ট্রেট করা হয় না। ফলে তারা তত্ত্ব জানে, কিন্তু প্রয়োগে হোঁচট খায়।
সমাধান হতে পারে উল্টো পথে—তত্ত্ব নয়, ভয়েস-বেইজড প্রাক্টিক্যাল লার্নিং। শিক্ষার্থীকে আগে শুনতে, তারপর বলতে এবং শেষে নিজেকে শুনে ভুল সংশোধন করতে শেখানো দরকার। শব্দের উৎস, গলার কম্পন, ঠোঁট ও জিহ্বার মুভমেন্ট যদি প্র্যাকটিক্যালভাবে শেখানো হয়, তাহলে শেখা হবে আরও দ্রুত, স্থায়ী ও কার্যকর।
বাংলাদেশে LTDEZ নামে একটি প্রতিষ্ঠান এই ভয়েস-কেন্দ্রিক শিক্ষণ পদ্ধতিতে কাজ করছে। তারা “Listen–Feel–Speak” মডেলের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শুদ্ধ উচ্চারণ ও অ্যাকসেন্ট ট্রেনিং করায়। গবেষণা-নির্ভর এই পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা কানে, মুখে ও কণ্ঠে একসঙ্গে ভাষার ধ্বনি উপলব্ধি করতে শেখে। ফলে ভয় ও জড়তা কাটে এবং শেখার প্রক্রিয়া হয়ে ওঠে প্রাকৃতিক ও আনন্দদায়ক—যা প্রচলিত তত্ত্বভিত্তিক পদ্ধতির তুলনায় অনেক বেশি কার্যকর।
অ্যাকসেন্ট ও উচ্চারণের জটিল অংশগুলো শেখাতে টাং টুইস্টার ড্রিল বিশেষভাবে কার্যকর। যেমন —‘ঝ’ সাউন্ডের জন্য- “ঝড়ে পড়ে ঝোপে ঝুলে ঝিঁঝিঁ পোকা ঝঙ্কারে ঝংকার তোলে।” আবার ‘খ’ সাউন্ডের জন্য “খলিল, খেলার খবর কি?’’ এই ধরনের অনুশীলন কণ্ঠ, জিহ্বা ও ঠোঁটের সমন্বয় ঘটায় এবং প্রাকৃতিকভাবে উচ্চারণকে শুদ্ধ ও সাবলীল করে।
একইসঙ্গে স্কুল কারিকুলামে আবৃত্তি, গান, নাটক, লিসেনিং ও বক্তৃতা অনুশীলন বাধ্যতামূলক করা এবং সেখানে পরীক্ষার নম্বর সংযুক্ত করা গেলে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বহুগুণে বাড়বে। এতে তারা বইয়ের শব্দ মুখস্থ নয়, ভয়েসে ভাষাকে জীবন্ত করতে শিখবে।
আমাদের দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ ও প্রশিক্ষণ অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে—যদি ভাষা শিক্ষায় ৩০–৪০% তত্ত্ব এবং ৬০–৭০% প্রাক্টিক্যাল অনুশীলন রাখা যায়, তাহলে উচ্চারণ ও অ্যাকসেন্ট শেখা হয় অনেক দ্রুত ও স্বাভাবিকভাবে। এটি কোনো আনুষ্ঠানিক গবেষণার পরিসংখ্যান নয়; বরং প্রয়োগ-ভিত্তিক সমষ্টিগত বিশ্লেষণ, যা বাস্তব প্রশিক্ষণে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে হাজারো শিক্ষার্থী ও বহু প্রকল্পে।
ভাষা শেখা কোনো মুখস্থবিদ্যা নয়; এটি এক ধরনের শারীরিক দক্ষতা (motor skill like)—যা কেবল অনুশীলনের মাধ্যমেই আয়ত্ত করা যায়। অতএব, মাতৃভাষার শুদ্ধ উচ্চারণ অর্জনের পথে দায় শিক্ষার্থীর নয়, দায় আমাদের শিক্ষা পদ্ধতির। তত্ত্ব নয়, প্রয়োগের মাধ্যমেই ফেরাই এই গুরুত্বপূর্ণ ভাষা-শিক্ষাকে-তাহলেই বাংলা হবে শুধু মাতৃভাষা নয়, শুদ্ধ ও সম্মানিত উচ্চারণের এক আদর্শ ভাষা।
লেখক-
শাহরিয়ার ইমন, শিক্ষা উদ্যোক্তা, ইংরেজি দক্ষতা গবেষক ও প্রতিষ্ঠাতা, এল টি ডি ই জেড
মন্তব্য করুন