কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দিয়ে তৈরি একটি ছবি। তাতে দেখা যাচ্ছে, মুখ ঢাকা একদল যুবকের হাতে হাতে পিস্তল-ছুরি। তারা অস্ত্রগুলো তাক করে আছেন পুলিশ সদস্যদের দিকে। আর বিপরীত দিকে পুলিশ সদস্যরা গোলাপ ফুল নিবেদন করছেন অস্ত্রধারীদের। পুলিশের হাতে আর মারণাস্ত্র থাকবে না, সরকারের এমন সিদ্ধান্তের পর পুলিশ সদস্যদের অনেকে প্রতিবাদ জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ ছবিটি পোস্ট করেছেন। তারা বলেছেন, মাথাব্যথা সারাতে মাথা কাটার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
পুলিশের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তারা বলেছেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে পুলিশ সদস্যদের বেপরোয়া মারণাস্ত্র ব্যবহারের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু যখন পুলিশ নিজের নিরাপত্তা নিয়ে নিশ্চিত থাকবে না, তখন সরকারের এই সিদ্ধান্ত হিতে বিপরীত হতে পারে। অপরাধীদের হাতে থাকা আধুনিক অস্ত্রের বিপরীতে শুধু শটগান বা খালি হাতে থাকা পুলিশ তাদের মোকাবিলা করতে পারবে না। এই সিদ্ধান্ত পুলিশের মনোবল বাড়ানোর পরিবর্তে আরও দুর্বল করে তুলবে। পুলিশের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হবে। তবে বিক্ষোভ বা আন্দোলন দমনে যেন মারণাস্ত্র ব্যবহার করা না হয়, সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলেছেন তারা।
সরকারের এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নুরুল হুদা কালবেলাকে বলেন, ‘সরকারের এই সিদ্ধান্ত প্রায়োগিক ক্ষেত্রে অনেক সমস্যার সৃষ্টি করবে। সেগুলো কীভাবে মোকাবিলা করবে, তার কৌশল থেকে থাকলে ভালো। চরম শক্তি প্রয়োগ করার বন্দোবস্ত যদি না থাকে, তাহলে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা বা জনশৃঙ্খলা রক্ষা করা খুব মুশকিল হয়ে যাবে। পুলিশকে তো মোকাবিলা করতে হয় সংঘটিত অপরাধীদের, উগ্রবাদীদের, চরমপন্থিদের। সাধারণ জনশৃঙ্খলার বিষয় যখন আসে তখন শক্তি প্রয়োগ করতে হয়। এখন যদি অস্ত্র না থাকে তাহলে কী দিয়ে সে মোকাবিলা করবে!’
গত ১২ মে সচিবালের আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদের নবম সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, পুলিশের হাতে আর কোনো মারণাস্ত্র থাকবে না। সভার সিদ্ধান্ত জানিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, ‘পুলিশের হাতে যেন আর কোনো মারণাস্ত্র না থাকে, এগুলো তাদের জমা দিয়ে দিতে হবে। কোনো মারণাস্ত্র পুলিশের হাতে থাকবে না; কিন্তু আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) হাতে থাকবে। এপিবিএনের কাজ অন্য পুলিশের থেকে ডিফারেন্ট।’
যখন পুলিশ কোনো অপারেশনে যাবে, তখন কীভাবে কাজ করবে—জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, ‘এপিবিএনের কাছে থাকবে। সাধারণ অপারেশনের সময় তো মারণাস্ত্রের দরকার নেই। যেটার দরকার নেই, সেটা তার সঙ্গে রাখারও দরকার নেই। তবে রাইফেল তো তার কাছে থাকবে।’
পুলিশের হাতে কোন ধরনের অস্ত্র রাখা যাবে, কীভাবে কাজ করবে, সেসব বিষয় ঠিক করতে এরই মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিযুক্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী খোদা বখস চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
পুলিশের কাছে মারণাস্ত্র না রাখার সিদ্ধান্তের পরদিন ১৩ মে এক অনুষ্ঠানে কথা বলেছেন আইজিপি বাহারুল আলম। তিনি বলেন, ‘অন প্রিন্সিপাল আমরা মনে করি, পুলিশ ক্যান নট বি আ কিলার ফোর্স। আমার কাছে বড়জোর শটগান থাকবে। এটাই একটা স্বাভাবিক প্রত্যাশা। যেসব জায়গায় বা বিশেষ জায়গাগুলোয় বিদ্রোহ হয় বা বিদ্রোহী থাকে সেসব জায়গায় পুলিশের কার্যক্রম ভিন্ন হয়। তবে স্বাভাবিকভাবেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশের কাছে যেন লিথাল ওয়েপন (প্রাণঘাতী অস্ত্র) না থাকে। পুলিশের কাছে নন-লিথাল ওয়েপন থাকাটা বিশ্বব্যাপী সমর্থন করে।’
সরকারের এই সিদ্ধান্তের পর পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, পুলিশের কাছে কী কী অস্ত্র থাকবে, তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঠিক করবে। যা নিয়ে কাজ চলমান। তবে মাঠ পর্যায়ে যে কোনো পুলিশি কার্যক্রম যেন ঝুঁকিমুক্ত থাকে, সে বিষয়টি বিবেচনায় রেখেই কাজ চলছে। চিহ্নিত দুর্ধর্ষ অপরাধী, চরমপন্থি বা সশস্ত্র বিদ্রোহীপ্রবণ এলাকায় কাজ করার সময় পুলিশের কাছে অস্ত্র থাকবে। যাতে পুলিশ সদস্যরা নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং অপরাধীদের মোকাবিলা করতে পারবেন।
পুলিশ সদর দপ্তরের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে মিছিল-সমাবেশ নিয়ন্ত্রণে পুলিশের মারণাস্ত্রের ব্যবহার বন্ধ নিয়ে কাজ হচ্ছে। মিছিল-সমাবেশ নিয়ন্ত্রণে মারণাস্ত্র ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। তাই এ বিষয়টিই বর্তমানে পর্যালোচনা করা হচ্ছে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে হতাহতের অধিকাংশ গুলির আঘাতে হয়েছে। তারা বলছেন, গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিশেষ করে পুলিশের বেপরোয়া মারণাস্ত্র ব্যবহার বন্ধের দাবি ওঠে। পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনেও পুলিশের হাতে প্রাণঘাতী আগ্নেয়াস্ত্র রাখার বিষয়ে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। এ ছাড়া গত ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলনেও পুলিশের হাতে প্রাণঘাতী অস্ত্র না রাখার সুপারিশ এসেছিল।
সংশ্লিষ্টরা বলেছে, এসব দাবি ও সুপারিশের ভিত্তিতেই সরকার পুলিশের কাছ থেকে মারণাস্ত্র নিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকারের এমন সিদ্ধান্তের পর পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলে জানা গেছে, এতে তারা কেউই সন্তুষ্ট নন। সরকারের সিদ্ধান্ত নিয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে বলেও মনে করেন তারা।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অন্তত ১০টি থানার দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১২ মে সিদ্ধান্ত হওয়ার পর কোনো নির্দেশনা মাঠ পর্যায়ে দেওয়া হয়নি। তবে কোনো কোনো থানা পুলিশ টহল ডিউটিসহ নিয়মিত কার্যক্রমে শুধু শটগান নিয়ে বের হচ্ছে। অন্য কোনো আগ্নেয়াস্ত্র নিচ্ছে না তারা।
ডিএমপির একটি থানার ওসি বলেন, ‘আমরা কোনো নির্দেশনা পাইনি। যা শুনছি মিডিয়া থেকে। তবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ও আইজিপি স্যারের বক্তব্যের পর ডিউটিতে শুধু শটগান নিয়ে বের হচ্ছে পুলিশ সদস্যরা। সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা পেলে পরবর্তীতে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা বলেন, সরকারের এই সিদ্ধান্তের পর শুধু পুলিশের মধ্যে নয়, সাধারণ মানুষের মধ্যেও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। বাংলাদেশকে ফিনল্যান্ড বা সুইজারল্যান্ড মনে করলে হবে না। পুলিশকে আপনি অপরাধীদের সামনে খালি হাতে পাঠাতে পারবেন না। বাংলাদেশের মানুষের যে অপরাধপ্রবণতা, তার সঙ্গে সরকারের এই সিদ্ধান্ত একেবারেই সাংঘর্ষিক।
তিনি বলেন, পুলিশকে নিরস্ত্র করা হলে, এখন যে মনোবল বাড়ানোর একটা প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, এতে ভাটা পড়বে। কে চাইবে, জীবনের ন্যূনতম সুরক্ষা ছাড়া অভিযান করতে! একজন সশস্ত্র অপরাধীকে ধরার জন্য কোনো পুলিশ সদস্য এগিয়ে যেতে চাইবে না। আর শটগান দিয়ে তো সেভাবে কাজ করা যাবে না। এ অস্ত্র দিয়ে নির্ধারিত দূরত্ব ছাড়া কাউকে ঘায়েল করা সম্ভব হয় না। কারণ এটা ছড়িয়ে যায়, আশপাশের মানুষকেও আঘাত করে।
এসআই পদে যোগদানের পর গত ২৪ বছর পুলিশে কাজ করে বর্তমানে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন করা এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, পুলিশের কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নেওয়া কোনো সমাধান নয়। এর ব্যবহার সঠিক হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করতে হবে। আইনের মধ্যে থেকে সে কাজটা করতে হবে। আর আমাদের পুলিশ যে আইনে চলে তাতে সুস্পষ্টভাবে সব বলা আছে। অস্ত্র হাতে থাকলেই গুলি করা যাবে না। গুলি করা হচ্ছে সর্বোচ্চ ধাপ। এর আগে অনেকগুলো ধাপ পার হতে হয়। সেগুলো সঠিকভাবে হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করতে হবে। পুলিশকে নিরস্ত্র করা বা শুধু শটগান দিয়ে অভিযানে পাঠানোর সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই বাস্তবসম্মত হবে না।
শটগানের বিষয়ে তিনি বলেন, শটগান একটি ভারী অস্ত্র। আর এটি নিয়ে চলাফেরাও করা মুশকিল। ব্যবহারের ক্ষেত্রে একজনকে টার্গেট করে কিছু করা যায় না। দূরত্ব বেশি হলে আশপাশের মানুষকে আহত করবে, যেখানে নিরীহ মানুষ থাকতে পারে। আর সারাবিশ্ব যেখানে হ্যান্ডস ফ্রি রেখে পুলিশিংয়ের কথা বলা হচ্ছে, ছোট অস্ত্রের ব্যবহার করতে বলা হচ্ছে, সেখানে আমরা শটগানের মতো বড় অস্ত্র ব্যবহারের জন্য পুলিশকে দিচ্ছি।
পুলিশের সাবেক একজন আইজিপি বলেন, সন্ত্রাসীরা যখন জানবে, পুলিশের কাছে শুধু শটগান আছে, তখন তো তারা পেয়ে বসবে। পুলিশ তাদের কাবু করতে পারবে না। উল্টো পুলিশ নিজে আক্রান্ত হবে। মারণাস্ত্র না থাকলে পুলিশ আত্মরক্ষার অধিকার থেকেও বঞ্চিত হবে।
বিরোধীমত বা দল দমনে পুলিশ যেনতেনভাবে যেন মারণাস্ত্রের ব্যবহার না করতে পারে, সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কামরুল হাসান তালুকদার। তিনি বলেন, বিরোধীদের আন্দোলন দমনে যেন মারণাস্ত্র ব্যবহার না হয়, সেই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। গত সরকারের আমলে এর ব্যবহার বিপজ্জনক হারে হয়েছে। পুলিশ তো শুধু আন্দোলন দমন করে না, সন্ত্রাসী, ডাকাত, অস্ত্রধারী, জঙ্গি, জলদস্যুদের গ্রেপ্তারে অভিযান করতে হয়। যেখানে এরকম প্রতিটি সংঘবদ্ধ চক্রের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র থাকে, সেখানে পুলিশ নিরস্ত্র অবস্থায় গিয়ে সফল হতে পারবে না।
পুলিশের হাতে অস্ত্র থাকা না থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অস্ত্র থাকলেই ব্যবহার করা যাবে, এমন নয়। ব্যবহার না করলেও সঙ্গে অস্ত্র থাকা একটা শক্তি, অপরাধীদের জন্যও এটা একটা ভয়। এখন অস্ত্র না থাকলে সেই ভয়টাও থাকবে না, একই সঙ্গে পুলিশের মনোবলও ভেঙে যাবে।
পুলিশের কাছে থাকা অস্ত্রের সঠিক ব্যবস্থাপনা মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নুরুল হুদা। তিনি বলেন, মূল সমস্যা অস্ত্র নয়, অস্ত্র ব্যবহারের কৌশল, নীতি এবং ব্যবস্থাপনা—সেগুলা জরুরি। ব্যবস্থাপনার মধ্যে এটা থাকবে, যারা ব্যবহার করছে সেটার যেন অপব্যবহার না হয়, তা তারা নিশ্চিত করবেন। গত ১৫ বছরে সরকার পুলিশকে দিয়ে যেভাবে অস্ত্র ব্যবহার করেছে, তা থেকে উদ্বেগের বিষয়গুলো এসেছে। কিন্তু ম্যানেজমেন্ট ও নির্দেশনা ঠিক থাকলে, অপব্যবহার রোধ করার বন্দোবস্ত থাকলে, মারণাস্ত্র অপব্যবহার কম হবে। যারা করবে তারাও আইনের আওতায় আসবে, জবাবদিহি নিশ্চিত হবে।
পুলিশের সাবেক এ শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, পুলিশ একটি আইনের অধীন শক্তি প্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠান। সেই শক্তি তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। তার হাত থেকে যদি অস্ত্র চলে যায়, তাহলে তার কর্তৃত্বের সম্পর্কে সন্দেহ উঠতে পারে। সন্দেহ হলে তার কাজ করা মুশকিল হয়ে যাবে। এগুলো নিশ্চয়ই চিন্তা করবে সরকার।
মন্তব্য করুন