আতাউর রহমান
প্রকাশ : ২৫ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২৫ আগস্ট ২০২৫, ০৮:০৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

থামছেই না গণপিটুনি

অপরাধ
থামছেই না গণপিটুনি

রংপুরের তারাগঞ্জের রূপলাল দাস (৪০) মেয়ের বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করতে পাশের উপজেলা মিঠাপুকুরের বালুয়া এলাকায় গিয়েছিলেন গত ৯ আগস্ট। বাড়ি ফিরতে সেদিন তার রাত হয়ে যায়। এজন্য ভাগ্নিজামাই প্রদীপ লাল দাসকে খবর দিয়ে তার ভ্যানে করে বাড়ি ফিরছিলেন মামাশ্বশুর-জামাতা। ফেরার পথে স্থানীয় বুড়িরহাট বটতলা মোড় সড়কে লোকজন তাদের পথরোধ করে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এক পর্যায়ে ভ্যানচোর সন্দেহে দুজনকে পিটিয়ে হত্যা করে জনতা।

পেশায় জুতা সেলাইয়ের কাজে যুক্ত রূপলাল আর তার ভাগ্নিজামাই প্রদীপ লালকে পিটিয়ে মারার পর প্রতিবাদে সড়ক অবরোধ করে সরব হয়েছিলেন তারাগঞ্জের মানুষ। তবে গণপিটুনি থামেনি। গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুক্রবার পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও কুমিল্লায় তিনজনকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়।

৮ মাসে গণপিটুনিতে প্রাণ গেছে ১১৮ জনের: মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য বলছে, গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২ মাসে গণপিটুনিতে ১২৮ জনের প্রাণ যায়। তবে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২২ আগস্ট পর্যন্ত আট মাসে গণপিটুনিতে ১১৮ জনের প্রাণ গেছে। এর মধ্যে চলতি মাসে ১৫ জন নিহত হন। এর মধ্যে গত জানুয়ারিতে ১৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১১, মার্চে ২০, এপ্রিলে ১৮, মে মাসে ১৩, জুনে ১১ ও জুলাইয়ে ১৪ জন প্রাণ হারান গণপিটুনিতে। সর্বশেষ গতকাল রোববার ভোরে পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলায় বাড়িতে ডাকাতি করে পালানোর সময় ধরা পড়ে গণপিটুনিতে ডাকাত দলের এক সদস্য নিহত হয়।

গণপিটুনিতে নিহত হওয়ার পর দায়ের হওয়া কয়েকটি মামলা বিশ্লেষণ ও নিহতদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশিরভাগ ঘটনাতেই নানা অপবাদ দিয়ে লোকজন আইন হাতে তুলে নিয়ে পিটিয়ে হত্যার মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে। এ ছাড়াও প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতেও গণপিটুনির ফাঁদ পাতা হয়ে থাকে।

রংপুরের তারাগঞ্জে রূপলাল ও প্রদীপ লালকে ভ্যানচোর অপবাদ দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হলেও পুলিশ তদন্ত করে নিশ্চিত হয়েছে, সেদিন ভ্যান চুরির কোনো ঘটনা ঘটেনি এবং ওই দুজন চোর ছিলেন না।

তারাগঞ্জ থানার ওসি এম এ ফারুক কালবেলাকে বলেন, নিহত দুজনের আগেও কোনো চুরি বা অপরাধের তথ্য মেলেনি। ঘটনার দিন ওই এলাকায় ভ্যান চুরির মতো কিছু ঘটেনি। এর পরও সেই অপবাদ দিয়েই তাদের মারা হয়েছে। কারা কেন তাদের মারল বা ঘটনার সূত্রপাত কীভাবে, সেটা তদন্ত চলছে।

সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে কোনো অপরাধে দেশে প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিচার হওয়ার কথা; কিন্তু উচ্ছৃঙ্খল লোকজন কোনো অপরাধীকে ধরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে না দিয়ে নিজেরাই আইন হাতে তুলে নিচ্ছে। অনেকে না জেনে ন্যূনতম যাচাই না করেই গুজব শুনে গণপিটুনির মতো ঘটনা ঘটিয়ে চলছে। অনেকে হীনস্বার্থ রক্ষায় পিটিয়ে হত্যার পর তা গণপিটুনি হিসেবে চালিয়ে দিচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে সমাজে সচেতনতা যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি আইনের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে সাধারণ মানুষকে। পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মধ্যে আস্থা বাড়াতে হবে যে, তারা বিচার পাবেন। তাহলে আইন হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা কমবে।

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. বশীর উদ্দীন খান কালবেলাকে বলেন, নানা কারণে মানুষ অসহিষ্ণু ও প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠায় গণপিটুনির মতো ভয়ংকর ঘটনাগুলো ঘটছে। এ ছাড়াও মোটা দাগে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা কমে আসা এবং বিচার পাবে না—এমন মানসিকতা সৃষ্টি হওয়ায় জনতা নিজেরাই আইন হাতে তুলে নিচ্ছে এবং শাস্তি নিশ্চিত করতে গিয়ে গণপিটুনির মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে। সবাই একসঙ্গে ‘বিচার’ করতে গিয়ে প্রাণ যাওয়ার মতো ভয়ংকর ঘটনা ঘটে যাচ্ছে।

এই অধ্যাপক বলেন, আইন ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা যেমন থাকতে হবে, তেমনি তা বাড়াতে বিচারে ও আইন প্রয়োগে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। গণপিটুনি যে একটা অপরাধ, সেই আইন সম্পর্কে মানুষকে জানাতে হবে। যারা এই অপরাধে জড়িত হয়েছে, তাদের শাস্তি নিশ্চিত করে উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে।

পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র সহকারী মহাপরিদর্শক এ এইচ এম শাহাদাত হোসাইন কালবেলাকে বলেন, গণপিটুনি ফৌজদারি অপরাধ। এ ধরনের অপরাধ সংঘটিত হলে পুলিশের পক্ষ থেকে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। গণপিটুনি দিয়ে হতাহত করার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারও করা হচ্ছে।

পুলিশের এ কর্মকর্তা বলেন, আসলে পুলিশ তার অবস্থান থেকে এই গণপিটুনি রোধে দায়িত্ব পালন করছে। তবে এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে সমাজসহ আরও নানা বিষয় যুক্ত। এ জন্য যার যার অবস্থান থেকে সক্রিয় হওয়া দরকার।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

স্কুলের সামনেই প্রাণ গেল শিক্ষার্থীর, মিষ্টি খাওয়ায় ব্যস্ত শিক্ষকরা

ডাকসু স্থগিতের প্রতিবাদে শহীদুল্লাহ হল থেকে শিক্ষার্থীদের মিছিল

ডাকসু নির্বাচন স্থগিতের বিষয়ে কী হবে জানালেন শিশির মনির

মালয়েশিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় দুই বাংলাদেশির মৃত্যু

দুধ দিয়ে গোসল করে জুয়া খেলা ছাড়লেন যুবক

শিশুদের জন্য লবণ কতটুকু প্রয়োজন, যা বলছেন পুষ্টিবিদ

ক্রিকেট বোর্ডের নির্বাচন কবে, জানিয়ে দিল বিসিবি

এক ওভারে দিলেন ৪৩ রান, করলেন ১৩ বল

কারামুক্ত হয়ে গানে ফিরছেন নোবেল

১৪ বছর ব্যাংকে চাকরির পর এখন ফুটপাতে করছেন ভিক্ষা

১০

ওয়ালটন লিফটের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হলেন সংগীতশিল্পী তাহসান

১১

নখ কাটলে কি অজু ভেঙে যায়?

১২

সেনাপ্রধানের রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ নিয়ে বিবৃতি

১৩

ডাকসু নির্বাচন স্থগিত

১৪

মাদক মামলায় ৪ জনের যাবজ্জীবন

১৫

অবাধে চলছে সংরক্ষিত বনের গাছ উজাড়

১৬

গেইল-পোলার্ডের এলিট ক্লাবে হেলস

১৭

আফগান মানুষ পাচারকারীদের অভিযান নিয়ে ‘ওয়েকিং আওয়ার্স’

১৮

জামায়াত নেতাদের জরুরি বৈঠক

১৯

আফগানিস্তানে ভূমিকম্পের ঘটনায় আহমাদুল্লাহর শোক

২০
X