খাবারের স্বাদ ও পুষ্টিগুণের সঙ্গে লবণের সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ভাত হোক, তরকারি হোক কিংবা যে কোনো রান্না— লবণ ছাড়া যেন অসম্পূর্ণ। প্রাচীনকাল থেকেই শুধু স্বাদের জন্য নয়, খাবার সংরক্ষণের উপাদান হিসেবেও লবণ ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তবে এই অতি পরিচিত উপাদানটি যেমন শরীরের জন্য অপরিহার্য, তেমনি এর মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি ডেকে আনে।
বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে লবণ গ্রহণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত জরুরি। কারণ, ছোট্ট শিশুর শরীর তখনো পুরোপুরি শক্তিশালী হয়ে ওঠেনি। অল্প বয়সেই যদি তারা বেশি লবণ খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলে, তবে পরবর্তী জীবনে উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি রোগ, হাড় ক্ষয় এমনকি হৃদরোগের ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যেতে পারে। আবার খুব কম লবণ খেলেও শরীরে নানা জটিলতা তৈরি হয়— মস্তিষ্কের বিকাশ ব্যাহত হয়, হরমোনের ভারসাম্যে আসে বিঘ্ন। তাই প্রশ্ন ওঠে, শিশুদের জন্য আসলে কতটুকু লবণ প্রয়োজন?
পুষ্টিবিদরা বলছেন, শিশুর বয়স অনুযায়ী লবণের পরিমাণ নির্ধারণ করা উচিত। রান্নায় বাড়তি লবণ না দিয়ে প্রাকৃতিকভাবে যে সোডিয়াম খাবারে থাকে, তা থেকেই শিশুদের চাহিদা অনেকাংশে পূরণ হয়ে যায়। তাই অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে, কারণ শিশুদের ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্য অনেকটাই নির্ভর করছে আজ তাদের খাদ্যাভ্যাস কেমনভাবে গড়ে তোলা হচ্ছে তার ওপর।
শিশুদের লবণ খাওয়ার পরিমাণ জানিয়ে সম্প্রতি দেশের একটি জনপ্রিয় টিভি চ্যানেলের সঙ্গে কথা বলেছেন দিনাজপুরের রাইয়ান হেলথ কেয়ার হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারের পুষ্টিবিদ লিনা আকতার।
চলুন, জেনে নিই তার পরামর্শ—
পুষ্টিবিদ লিনা আকতার জানিয়েছেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুযায়ী একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের শরীরে প্রায় দিনে ৫ গ্রাম লবণ প্রয়োজন। এই ৫ গ্রাম লবণে ২০০০ মিলিগ্রাম সোডিয়াম থাকে। ১ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য ১ গ্রামের কম লবণের প্রয়োজন। কারণ, শিশু যে প্রাকৃতিক খাবার খায় (মাংস, দুধ, ডিম, ইত্যাদি) এতে সোডিয়াম উপাদান থাকে। বলা হয় যে, প্রতিদিনের খাবারে প্রাকৃতিকভাবে ৪০০ মিলিগ্রাম সোডিয়াম থাকে, যা ১ গ্রাম লবণের সমতুল্য।
লিনা বলেন, ১ থেকে ৩ বছর বয়সী শিশুদের জন্য লবণের পরিমাণ প্রতিদিন প্রায় ৩ গ্রাম পর্যন্ত। আর ৭ বছর বা তার বেশি বয়সী শিশুদের ৫ গ্রাম লবণ প্রয়োজন হতে পারে। এ জন্য শিশুদের অতিরিক্ত লবণ খাওয়ার প্রয়োজন নেই। কেননা, অতিরিক্ত লবণ শিশুর রেচনতন্ত্রকে প্রভাবিত করে।
আমাদের সবারই সুস্বাস্থের জন্য লবণের প্রয়োজন, কিন্তু অতিরিক্ত নয়। আবার খুব কম লবণ শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশে বাধাগ্রস্ত হবে, যা শিশুর থাইরয়েড হরমোনকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করবে।
শিশুরা অতিরিক্ত লবণ খেলে কী সমস্যা হতে পারে?
পুষ্টিবিদ লিনা আকতার বলেন, কম বয়সী শিশুরা অতিরিক্ত লবণ খেলে অ্যানোরেক্সিয়া এবং শরীরে পানির ভারসাম্যহীনতার কারণে বেশি ক্লান্ত অনুভব করতে পারে। অতিরিক্ত লবণের পাশাপাশি সোডিয়াম পাবে বেশি। অতিরিক্ত সোডিয়াম প্রস্রাবে ক্যালশিয়াম নির্গমনের ঝুঁকি বাড়ায়। ফলে ক্যালশিয়ামের ঘাটতির ঝুঁকি হতে পারে, যা শিশুর উচ্চতা বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলে। পরবর্তীতে শিশুদের রিকেট, কিডনি ফেইলর এবং অ্যানোরেক্সিয়ার ঝুঁকি বেড়ে যাবে। এছাড়া ছোট বয়সের শিশু বেশি লবণ খেয়ে বড় হলে তারা স্বাভাবিকভাবেই বেশি লবণ খেয়ে অভ্যাসে পরিণত হবে।
আরও পড়ুন : গরম পানি পান করলে কি সত্যিই ওজন কমে
আরও পড়ুন : টয়লেটে বসে দীর্ঘ সময় কাটান? যে ভয়াবহ রোগের ঝুঁকির কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
তিনি আরও বলেন, অতিরিক্ত লবণ খেলে অল্প বয়সে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, কিডনি রোগ ও শিশুদের অল্প বয়সে হাড় ক্ষয়ের ঝুঁকি থাকে। খাবারে লবণের পরিমাণ সীমিত করা শিশুর খাদ্য নির্বাচনের অভ্যাস এবং রান্নার অনুশীলনের ওপর অনেকটাই নির্ভর করে। একই সময়ে মাঝারি এবং কম সোডিয়ামযুক্ত খাবার বেছে নেওয়া উচিত। শিশুদের প্রাকৃতিক খাবার খাওয়ানো তাদের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। শিশুদের সুস্থ ও ভালো বিকাশের জন্য প্রয়োজন পরিমাণ ও গুণমাণের ভারসাম্যের দিক থেকে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ। পর্যাপ্ত ও সুষম পুষ্টি সরবরাহ করা না হলে শিশুরা সহজেই পুষ্টির অভাবজনিত রোগে ভুগবে, যা শারীরিক ও মানসিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
বয়স অনুযায়ী দৈনিক লবণ গ্রহনের সর্বোচ্চ পরিমাণ (বিশ্ব স্বাস্থ্য-২০১২)
১ থেকে ৩ বছর : ২ গ্রাম/দিন। ৪ থেকে ৬ বছর : ৩ গ্রাম/দিন। ৭ থেকে ১০ বছর : ৫ গ্রাম/দিন। ১১ বছরের বেশি হলে : ৫ থেকে ৬ গ্রাম/দিন।
মন্তব্য করুন