

এক বছরের বেশি সময় ধরে এএবির (অটোমোবাইল অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ) ইস্যুকৃত লাইসেন্স ভুয়া বলে বিবেচিত হচ্ছে; কিন্তু এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে কিছুটা উদ্যোগ নেওয়া হলেও তাতে কোনো ফল মেলেনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এএবি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ফেডারেশন ইন্টারন্যাশনাল ডি ল অটোমোবাইলের (এফআইএ) একমাত্র সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ থেকে আন্তর্জাতিক ড্রাইভিং পারমিট ইস্যু করে। এফআইএর শর্ত অনুযায়ী সেই লাইসেন্স বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) থেকে অনুমোদিত হতে হয়। কিন্তু ২০২৪ সালের জুন থেকে এএবি কর্তৃপক্ষ সেসব লাইসেন্স ইস্যু করেছে, এর কোনোটাই অনুমোদিত হয়নি।
একটি লাইসেন্স ইস্যু করে গ্রাহকদের কাছ থেকে আগে ২ হাজার ৫০০ টাকা নিত এএবি। এর থেকে ২১৮ টাকা বিআরটিএকে কর দিত। গত বছরের জুন থেকে এই কর দেওয়া বন্ধ রেখেছে এএবি। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে এএবি প্রায় ৩০ হাজার আন্তর্জাতিক ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু করেছে। বিআরটিএর অনুমোদন না থাকায় এসব লাইসেন্স কার্যত অবৈধ হচ্ছে।
২০২৪ সালের মার্চ থেকে বিআরটিএর চালান এবং কাউন্টার সাইন বন্ধ করার পর লাইসেন্স পারমিটের বই পরিবর্তন করে এএবি। ২০১৭ সালের ১৬ আগস্ট শ্রাবণী বড়ুয়া নামের এক গ্রাহকের আন্তর্জাতিক ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু হয়েছে। ইস্যু হওয়া সেই লাইসেন্সে সরকারের অনুমোদন করা একটি সত্যায়িতকরণ চিহ্ন দেখা যায়। এতে ইংরেজি ভাষায় ‘গভ. অব দ্য পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ এবং ‘বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি’ লেখা ছিল। দুই লেখার মাঝে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ‘এআইটি’র লোগো ছিল। কিন্তু ২০২৫ সালের ২৬ জুলাই ইস্যু করা মো. মোজাহিদুল হক চৌধুরীর লাইসেন্সে এমন কোনো সত্যায়ন দেখা যায়নি। তবে বাংলাদেশের নাম, পতাকা ও শাপলার প্রতীকী লোগো তাতে ছিল।
বিআরটিএ সূত্র বলছে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এএবি এখন যে লাইসেন্স প্রদান করছে, এর সঙ্গে বিআরটিএর কোনো সম্পর্ক নেই। বিআরটিএর তথ্যভান্ডারে এসব লাইসেন্সের কোনো তথ্য রাখা হচ্ছে না। ফলে সরকারি ওয়েবসাইটে এএবির ইস্যু করা আন্তর্জাতিক লাইসেন্সের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়ার সুযোগ নেই। তাই স্বাভাবিকভাবেই এসব লাইসেন্স অবৈধ হিসেবে বিবেচিত হবে। তারা কেন লাইসেন্স দিচ্ছে—এ বিষয়ে জানতে চেয়ে এএবিকে চিঠিও দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গত ৩ সেপ্টেম্বর সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান কালবেলাকে বলেন, ‘ওদের সঙ্গে আলোচনার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কাজ হচ্ছে না। এসব করে লোক ঠকানো হচ্ছে। সাধারণ মানুষ প্রতারিত হচ্ছে। ব্যবস্থা নিতে আইনি দিকগুলো খুঁজে দেখা হচ্ছে।’
১৯৪৯ সালে জাতিসংঘের এক সিদ্ধান্তে (রেজ্যুলেশন) বলা হচ্ছে, স্বাক্ষরকৃত প্রতিটি দেশ আন্তর্জাতিক ড্রাইভিং পারমিট ইস্যু করতে পারবে এবং স্বাক্ষরকৃত এক দেশের পারমিট দিয়ে অন্য দেশে গাড়ি চালানো যাবে। মূলত ট্রাফিক শৃঙ্খলা ঠিক রাখতে এমন সিদ্ধান্ত হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৬ সালে এই রেজ্যুলেশনে সম্মতি দিয়ে যুক্ত হয়। তখন দেশে ড্রাইভিং লাইসেন্সের অনুমোদন দিত পুলিশ। এএবি পুলিশের কাছ থেকে অনুমোদন নিয়ে আন্তর্জাতিক ড্রাইভিং পারমিট ইস্যু করা শুরু করে। এরপর বিআরটিএ প্রতিষ্ঠিত হলে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার কর্তৃত্ব পায় এই সংস্থা। কিন্তু বিআরটিএর কাছ থেকে পরে এএবি আর কোনো অনুমোদন নেয়নি।
বিআরটিএর সংশ্লিষ্ট বিভাগের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা গত ২৮ আগস্ট কালবেলাকে বলেন, ‘এতদিন ধরে এএবি বিআরটিএর বিভিন্ন কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল। বিআরটিএকে অফিসিয়াল ট্যাক্স দেওয়া অব্যাহত থাকায় এটি কোনো গুরুত্ব পায়নি। কিন্তু এখন তারা ড্রাইভিং পারমিটে বিআরটিএর নামই ব্যবহার করছে না, কোনো ট্যাক্সও দিচ্ছে না।’
গত ১০ এপ্রিল সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. এহছানুল হকের সভাপতিত্বে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেই বৈঠকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট ১৩টি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের ডাকা হয়। বৈঠকে এএবির আন্তর্জাতিক ড্রাইভিং পারমিট (আইডিপি) ইস্যু করার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ এবং সড়ক পরিবহন বিধিমালা, ২০২২ অনুযায়ী বিআরটিএ ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু করে। এএবি কোন প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক ড্রাইভিং লাইসেন্স দিচ্ছে, তা জানতে চেয়ে গত ৩ এপ্রিল একটি চিঠি দেওয়া হয়। বিআরটিএর ড্রাইডিং লাইসেন্স শাখার উপপরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং) মো. ইব্রাহীম খলিল সেই চিঠি স্বাক্ষর করেন।
সেই সঙ্গে নিজেদের ইচ্ছামতো লাইসেন্সের ফি বাড়ানোর প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। আগে যেখানে সাধারণ প্রক্রিয়ায় আইডিপি পেতে ২ হাজার ৫০০ টাকা দিতে হতো, এখন সেখানে দিতে হয় ৪ হাজার ৭০০ টাকা। আর আগে দ্রুত পারমিট পেতে চার্জ দিতে হতো ৩ হাজার ৫০০ টাকা। এখন দ্রুততার চার্জ তিন ধাপে ভেঙে ঠেকেছে ১৩ হাজার ৭০০ টাকায়। ১৫ দিনে পারমিট পেতে চার্জ দিতে হয় ৭ হাজার ৭০০ এবং সাত দিনে পারমিট পেতে চার্জ দিতে হয় ১০ হাজার ৭০০ টাকা। এরই মধ্যে ছয় মাস পার হলেও বৈধতার প্রশ্ন এবং লাইসেন্সের অস্বাভাবিক ফি বাড়ানোর বিষয়ে কোনো নিষ্পত্তি হয়নি।
পরিবহন শ্রমিক নেতা মোহাম্মদ হানিফ খোকন কালবেলাকে বলেন, ‘এই লাইসেন্স করলেও বিদেশ গিয়ে আবার লাইসেন্স করতে হয়। তাহলে এটার ভ্যালু কী। বহু পরিবহন চালক এই লাইসেন্স নিয়ে বিদেশে গিয়ে প্রতারিত হয়েছেন।’
কেন কর দেন না, সত্যায়ন কেন করাচ্ছেন না, ফি কেন বাড়িয়েছেন এবং লাইসেন্স বই কেন পরিবর্তন করা হয়েছে—এসব বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হয় এএবির প্রধান কারিগরি কর্মকর্তা মামুন আহামেদ মারুফকে। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘গত ১০ বছরে লাইসেন্সের ফি বাড়েনি। তাই এখন বাড়ানো হয়েছে। ডলারের দাম বেড়েছে, সেটাও খেয়াল রাখতে হবে। নকল ঠেকাতে বইয়ের মডেল পরিবর্তন করা হয়েছে। আমরা এফআইর সঙ্গে আলোচনা করেই এটা করেছি।’
তিনি দাবি করেন, ‘এখন বিআরটিএর সত্যায়নের দরকার পড়ে না। যাদের নিয়মিত ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে, তাদের আমরা ইন্টারন্যাশনাল ড্রাইভিং লাইসেন্স দিতে পারি।’ তিনি বলেন, ‘বিআরটিএকে কর দেওয়া বন্ধ ছিল এটা ঠিক। কিন্তু এখন দেওয়া হচ্ছে।’ দুই মাস ধরে তারা কর পরিশোধ করছেন বলে দাবি করেন।
উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক লাইসেন্স নিতে হলে বিআরটিএর লাইসেন্স থাকতে হয়। বিআরটিএর লাইসেন্স দেখেই এএবি আন্তর্জাতিক লাইসেন্স ইস্যু করে।
বিআরটিএর সত্যায়নের দরকার হয় না বলে মামুন আহামেদ মারুফ দাবি করলেও খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ইন্টারন্যাশনাল ড্রাইভিং লাইসেন্সে সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের অনুমোদন থাকতে হবে।
এসব বিষয়ে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক শামছুল হক কালবেলাকে বলেন, ‘বিআরটিএ কেন আন্তর্জাতিক ড্রাইভিং লাইসেন্স দিতে পারছে না, সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা দরকার। তা ছাড়া একটি লাইসেন্স নিয়ে গাড়ি চালানোর সুযোগ থাকে। কেন না, এই পুরো পদ্ধতিটা জাতিসংঘ ঠিক করে দিয়েছে। লাইসেন্স পাওয়ার পদ্ধতি, সড়কে চলার নিয়ম সব দেশে একই। আমেরিকার লাইসেন্স নিয়ে তো আমার দেশে ঠিকই গাড়ি চালানো যায়। তাহলে আমার দেশের লাইসেন্স দিয়ে অন্য দেশে কেন গাড়ি চালানো যাবে না। আমাদের সরকারি প্রতিষ্ঠানের কেন সেই গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হলো না।’
মন্তব্য করুন