চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলা শহর সংলগ্ন ইউনিয়ন ‘মেখল’। নামটি মেখলা শব্দ থেকে এসেছে। নারীদের পরিধানকৃত স্বর্ণালংকারকে মেখলা বলা হয়। এ ছাড়া হালদা নদীর অনেক উপনদী ওই গ্রামের মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে এজন্য মেখলা নামের উৎপত্তি বলে অনেকের ধারণা। সেই স্থানে বাংলার বিখ্যাত বৈষ্ণব চূড়া মনি শ্রীলপুণ্ডরীক বিদ্যানিধির জন্ম। বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদের রচয়িতা কাহ্নপাদের প্রধান শিষ্য ‘মেখলা’। এখানেই মহাকবি নবীন চন্দ্র সেনের পূর্বপুরুষ বসতি স্থাপন করেছিলেন।
হাটহাজারীর সেই ঐতিহ্যবাহী মেখলে আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ (ইসকন) পরিচালিত শ্রী শ্রী পুণ্ডরীক ধামের জমি বেদখল হয়ে গেছে। ইসকনের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, সাবেক মন্ত্রী ও রাষ্ট্রদূত মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন এবং তার ছেলে ব্যারিস্টার মীর হেলাল উদ্দিন ধর্মীয় ওই প্রতিষ্ঠানের জমি কৌশলে দখলে নিয়েছেন। বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান মীর নাছির ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে এমন অপকর্মটি করেছেন বিএনপি জোট সরকারের আমলে মন্ত্রী থাকাকালে। এ বিষয়ে নানা বক্তব্য তুলে ধরে গত রোববার চট্টগ্রামে এক সংবাদ সম্মেলন করে ইসকন।
নিজেদের বিরুদ্ধে ওঠা এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির অন্যতম সদস্য মীর হেলাল উদ্দিন কালবেলাকে বলেন, জায়গাটি মীর আহমেদ সওদাগর কিনেছেন ১৯৫১ সালে, আর আমার আম্মা কিনেছেন ১৯৯২-৯৩ সালে। প্রায় ৭২ বছর ধরে শান্তিপূর্ণভাবে ভোগদখলে থাকার পর নির্বাচন সামনে রেখে হঠাৎ পানি ঘোলা করার অপচেষ্টা করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, উনারা আমার আম্মার নির্মিত ৩০ বছর পুরোনো দেয়াল ভেঙে ফেলেছেন এবং অনেক গাছ যেগুলো আমার আম্মা নিজ হাতে রোপণ করেছিলেন সেগুলোও কেটে ফেলেছেন। তিনি বলেন, বিচারাধীন বিষয় নিয়ে বিচার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার অপচেষ্টা এবং অসত্য, ভিত্তিহীন দাবি তোলাও দুঃখজনক।
হাটহাজারী উপজেলার মেখল ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডে পুণ্ডরীক ধামের অবস্থান। শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর সংকীর্তন আন্দোলনের অন্যতম প্রধান ভিত্তিভূমি এই শ্রীধাম। পুণ্ডরীক ধামে শ্রী শ্রী রাধাকৃষ্ণ মন্দির, কাত্যায়নী মন্দির, পুণ্ডরীক বিদ্যানিধি মন্দির, শ্রীলপ্রভুপাদের মন্দির, রাধাকুণ্ড ও গিরি গোবর্ধন মন্দির রয়েছে। এ ছাড়া ধামে অনাথ আশ্রম, লাইব্রেরি ভবন, প্রসাদালয় ও গোশালা আছে। পুণ্য হাসিলের উদ্দেশ্যে পর্যটক-তীর্থযাত্রীরা এসব দেখতে এখানে ছুটে আসেন।
ওই প্রতিষ্ঠানের নামে শত বছর আগের দেবোত্তর সম্পত্তির এক একরের বেশি জমি মীর নাছির দখলে নিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন পুণ্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ শ্রী পাদ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী। বিষয়টি নিয়ে আদালতে মামলা করেছেন বলেও জানান তিনি।
অধ্যক্ষ চিন্ময় কালবেলাকে জানান, পুণ্ডরীক ধাম যখন প্রায় অবলুপ্ত হতে যাচ্ছিল, তখন পুণ্ডরীক বিদ্যানিধি স্মৃতি সংসদ ১৯৮২ সালে ইসকনকে প্রতিষ্ঠানটির সেবাভার অর্পণ করে। প্রতি বছর দেশ-বিদেশের হাজারো পর্যটক-তীর্থযাত্রী এখানে আসেন। এখানকার পুরো সম্পত্তি পুণ্ডরীক বিদ্যানিধির বংশধারায় কৃষ্ণ কিংকর বিদ্যালঙ্কারের নামে সিএস জরিপে নামজারি আছে। কৃষ্ণ কিংকর বিদ্যালঙ্কার ১৯১০ ও ১১ সালে নিরলক্ষিজনার ধন বিগ্রহের নামে যেটি পুণ্ডরীক বিদ্যানিধির আরাধ্য নামে বা দেববিগ্রহের নামে দেবোত্তর (যা বিক্রি করা যাবে না) করে যান। পুণ্ডরীক ধাম আরএস জরিপে চূড়ান্ত লিপিতে চিরস্থায়ী দেবোত্তর হিসেবে উল্লেখিত রয়েছে। কিন্তু পুণ্ডরীক ধামের মূল চলাচলের পথ আজিজিয়া মজিদিয়া সড়ক লাগোয়া পুণ্ডরীক ধাম প্রাইমারি স্কুল সংলগ্ন কিছু জায়গা (যাতায়াতের পথ ও পুকুর) মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন এবং তার ছেলে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য মীর হেলাল উদ্দিন ভুয়া দলিলের মাধ্যমে ক্রয় দেখিয়ে পাকা প্রাচীর তৈরি করে অবৈধভাবে দখলে নেন। যে দলিলে পারস্পরিক কোনো সম্পর্ক নেই। তারা বাবা-ছেলে মিলে ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজেদের নামে বিএস নামজারিও করেছেন। বর্তমানে চলাচলের যে রাস্তা তা খতিয়ানে ‘খাই’ হিসেবে লিপিবদ্ধ থাকলেও ক্ষমতাবলে তা সড়কে পরিণত করা হয়েছে।
হাটহাজারী মেখল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. সালাউদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে কোনো পক্ষ আমার পরিষদে অভিযোগ করেননি। তবে এক রাতে পুণ্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ আমাকে ফোন করে বলেছেন, তাদের মালিকানাধীন জমির ওপর নাকি মীর নাছির দেয়াল তুলে দিচ্ছেন। ওই সময় আমি বলেছিলাম, তাকে আইনগত ব্যবস্থা নিতে। এরপর আর কিছুই জানি না।’
মেখল ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মোহাম্মদ রফিক কালবেলাকে বলেন, ‘জনৈক মীর আহমেদ সওদাগরের কাছ থেকে জায়গাটি সাবেক মন্ত্রী মীর নাছির উদ্দিন নিয়েছেন বলে জানি। পুণ্ডরীক ধাম সেখানে জায়গা পাবে কি না জানি না। তবে শুনেছি, মীর নাছির যে সীমানা দেয়ালটি দিয়েছেন, সেটা নাকি সরকারি জায়গার ওপর।’
পুণ্ডরীক ধামের মামলার আইনজীবী অ্যাডভোকেট শুভাশীষ শর্মা কালবেলাকে বলেন, চলাচলের রাস্তা বিরোধ ঘিরে আদালতে একটি মামলা রয়েছে। এই মামলায় বিএনপি নেতা মীর নাছির উদ্দিন, মীর হেলাল উদ্দিনসহ আরও কয়েকজনকে আসামি করা হয়েছে। আদালত এই মামলা গ্রহণ করে উপজেলার এসিল্যান্ডকে তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন এবং যেন কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে সে জন্য স্থিতাবস্থায় রাখার জন্য থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকেও নির্দেশ দেন।
মন্তব্য করুন