‘আমি তো হরতাল-অবরোধ বুঝি না, রিকশা চালাইয়া খাই। আমারে আগুন দিয়া পোড়ালে কেন? ১০ দিন ধইরে রিকশা চালাইতে পারি না। হাসপাতালে শুয়ে আছি। সংসার চলছে না, পোলা-মাইয়া না খেয়ে আছে।’ শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের শয্যায় শুয়ে কথাগুলো বলছিলেন আবদুল জব্বার।
মুখমণ্ডলের পোড়া ক্ষত শুকালেও তার দুই হাতে পোড়া দগদগে ঘা। দুই পা সাদা ব্যান্ডেজে মোড়ানো। বিএনপির ডাকা চতুর্থ দফা অবরোধের আগে গত ১১ নভেম্বর রাতে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় অনাবিল পরিবহনের বাসে দেওয়া আগুনে দগ্ধ হন তিনিসহ কয়েক যাত্রী। এরপর থেকে হাসপাতালের বিছানায় পোড়া যন্ত্রণায় ছটফট করছেন এ রিকশাচালক।
জব্বারের স্ত্রী ফজিলাতুন্নেছা জানান, হরতাল-অবরোধ হওয়ায় তার স্বামী সেদিন রিকশা গ্যারেজে রেখে নারায়ণগঞ্জে ভাইয়ের বাসায় যাচ্ছিলেন। এর পরও রক্ষা হয়নি। তারা নীলফামারীর জলঢাকায় গ্রামের বাড়ি থাকেন। স্বামীর এমন খবর পেয়ে ঋণ করে ভাড়ার টাকা জুগিয়ে ঢাকায় এসেছেন। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে বার্ন ইনস্টিটিউটের ৫২০ নম্বর ওয়ার্ডের ২৫ নম্বর শয্যায় তার সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন বোঝা গেল জব্বার রাজনীতি করেন না, বোঝেনও না। তার আক্ষেপটাও সেখানেই। নিজের পোড়া যন্ত্রণা ভুলে তার তিন শিশু ছেলে, এক মেয়ে আর স্ত্রী নিয়ে ভবিষ্যতে চলবেন কীভাবে—সেই চিন্তাই তাকে বেশি কাতর করে দিচ্ছিল। কিছুটা ক্ষোভও ঝরল তার কণ্ঠে, বললেন, ‘সরকার ওগো পোড়াইয়া দেয় না কেন? তাইলে বুঝবে পোড়া যন্ত্রণা কত অসহ্য।’
শুধু জব্বার নন, গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশ ঘিরে যানবাহনে অগ্নিসংযোগ শুরু হয়। পরে তা হরতাল-অবরোধেও চলতে থাকে। এই ভয়ংকর নাশকতায় এরই মধ্যে অগ্নিদগ্ধ হয়ে দুজন পরিবহন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। দগ্ধ হয়েছেন অনেকে। দেখা যায়, শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে গতকাল পর্যন্ত সাতজন পোড়া যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন।
ওই সাতজনের একজন রবিউল ইসলাম রবি (১৮)। পেশায় বাসের হেলপার। ২৯ অক্টোবর রাতে ‘অসীম পরিবহনের’ বাসটি ডেমরার স্টাফ কোয়ার্টার এলাকায় রেখে আরেক সহকর্মী নাঈমকে নিয়ে ঘুমিয়ে ছিলেন তিনি। গভীর রাতে সেটিতেও আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। ঘুমন্ত অবস্থায় দগ্ধ হন দুজন। চোখের সামনেই ছটফট করে মারা যান সহকর্মী নাঈম। শরীরে আগুন নিয়েই বাসের জানালা দিয়ে লাফিয়ে প্রাণ রক্ষা হলেও ২২ দিন ধরে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি।
গতকাল রবিউলের সঙ্গে কথা বলার সময় থরথর করে কাঁপছিলেন। জানালেন, সেই রাতের কথা এখনো ভুলতে পারেননি। ‘আমাগো দোষ কী? আমরা তো কাম করে খাই। আমাগো আগুন দেয় কেন?’—বলতে বলতে রবিউলের চোখ বেয়ে পানি বেরিয়ে আসে। সেই পানি দগ্ধ মুখমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়লে পোড়া ঘা আরও দগদগ করে।
বাসের হেলপার রবিউলের ছোট্ট প্রশ্নগুলোর জবাব না মিললেও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পরিচ্ছন্নতাকর্মী মানিক দাশ বুঝতেই পারছেন না, তাকে কেন দগ্ধ হতে হয়েছে। রবিউলের পাশের শয্যায় চিকিৎসাধীন মানিক জানান, ১২ নভেম্বর ডিউটি শেষে রাতে এয়ারলাইন্সের বাসেই ফিরছিলেন হাজারীবাগের বাসায়। বাসটি বনানীতে যেতেই পেট্রোল বোমা ছোড়া হয়। এতে তার মতো কয়েক কর্মী দগ্ধ হলেও তারটা গুরুতর।
মানিক জানান, তার একটিমাত্র মেয়ে, সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। স্ত্রী পিংকি সরকার হাসপাতালে তার শয্যা পাশে থাকায় মেয়েটি বাসায় একা থাকে। বাবার এ অবস্থায় সে বার্ষিক পরীক্ষাতেও অংশ নিতে পারছে না।
মাহমুদ হাসান নারায়ণগঞ্জে একটি তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। ১১ নভেম্বর সেখান থেকে ঢাকায় এসেছিলেন শখের মোবাইল ফোন কিনতে। ফেরার পথে যাত্রাবাড়ী এলাকায় অনাবিল পরিবহনের বাসে দেওয়া আগুনে দগ্ধ হন তিনি। মাহমুদ জানান, তার চাকরির টাকায় সংসার চলে। কিন্তু ১০ দিন ধরে হাসপাতালে। চাকরি টিকবে কি না, বুঝতে পারছেন না।
ওই তিনজনের মতো বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ২৮ অক্টোবর রাজধানীর কাকরাইলে দগ্ধ হওয়া মো. শাখাওয়াত, ৫ নভেম্বর মেরাদিয়ায় দগ্ধ হওয়া মো. সবুজ, ১২ নভেম্বর যাত্রাবাড়ীতে দগ্ধ হওয়া বিপ্রজিত দাশ এবং মো. হাসান।
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন দৈনিক কালবেলাকে বলেন, গত ২৮ অক্টোবরের পর সাত রোগী দগ্ধ হয়ে ভর্তি হয়েছেন। তাদের সবার বয়স ২৫ থেকে ৪৫ বছর। তারা সবাই কর্মক্ষম মানুষ। পেট্রোল বোমা কিংবা বাসের মধ্যে আগুনের তীব্রতা খুব বেশি হয়। তাদের শরীরের ভেতরের চামড়াও পুড়ে গেছে। এজন্য এসব রোগীকে অনেক দিন হাসপাতালে থাকতে হতে পারে। অনেকের অস্ত্রোপচারও করতে হবে। প্রায় সবার শ্বাসনালি পুড়ে গেছে। তাদের কেউ শঙ্কামুক্ত নন।