আর মাত্র কয়েকদিন পরই শুরু হচ্ছে নতুন শিক্ষাবর্ষ। ১ জানুয়ারি বই উৎসবের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের নতুন বই তুলে দেওয়া রেওয়াজে পরিণত হয়ে গেছে। জাতীয় নির্বাচনের কারণে এবার বই উৎসবে ভাটা পড়েছে। প্রাথমিকে বই উৎসবের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) অনুমতি মিললেও মাধ্যমিকের বই উৎসবের অনুমতি মেলেনি। সে কারণে মাধ্যমিকের বই উৎসব এবার হচ্ছে না। তবে প্রাথমিক স্তরে কেন্দ্রীয়ভাবে এই উৎসব হবে বলে জানা গেছে। আবার বছরের প্রথম দিনেই নতুন বই ঘিরে উচ্ছ্বাস করে শিক্ষার্থীরা। বাড়িতে গিয়ে পাতা উল্টে দেখতে থাকে কোন পাতায় কী লেখা আর ছবি রয়েছে। অষ্টম ও নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা বছরের শুরুতেই এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে। কারণ, ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে এ দুই শ্রেণির সব বই উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছাবে না। এ ছাড়া এবারও নিম্নমানের কাগজে বই ছাপার খবর পাওয়া যাচ্ছে।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সূত্র জানায়, ২০২৪ শিক্ষাবর্ষে ৩ কোটি ৮১ লাখ ২৭ হাজার ৬৩০ শিক্ষার্থীর জন্য ৩০ কোটি ৭০ লাখ ৮৩ হাজার ৫১৭ কপি বই ছাপা হচ্ছে। প্রথম, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য ছাপানো হয়েছে ৫ কোটি ৩৮ লাখ ৩ হাজার ৪২৩ কপি বই। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির বই সংখ্যা ৩ কোটি ৩৬ লাখ ১ হাজার ২৭৪টি। প্রাক-প্রাথমিকের জন্য ৬১ লাখ ৯৩ হাজার ৮৭৮ কপি বই ছাপা হয়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে ৬ কোটি ৪৫ লাখ ৪৮ হাজার ৩০৮ কপি, সপ্তম শ্রেণির ৪ কোটি ৪৫ লাখ ৫৭ হাজার কপি, অষ্টম শ্রেণির জন্য ৫ কোটি ৩৪ লাখ ৮৪ হাজার ২৭১ কপি এবং নবম শ্রেণির জন্য ৫ কোটি ৬ লাখ ৮৪ হাজার ৫৭৩ কপি বই ছাপা হচ্ছে। অন্যদিকে, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর (পাঁচটি ভাষায় রচিত) শিশুদের জন্য এবার মোট ২ লাখ ৫ হাজার ৩১ কপি বই ছাপা হচ্ছে। অন্য বইয়ের মধ্যে ৫ হাজার ৭৫২ কপি ‘ব্রেইল’ বই ছাপা হবে। তা ছাড়া শিক্ষকদের ৪০ লাখ ৯৬ হাজার ৬২৮টি ‘শিক্ষক সহায়িকা’ দেওয়া হবে।
এনসিটিবি সূত্র জানিয়েছে, মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির প্রায় সব বই উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। তবে অষ্টম শ্রেণির বই গিয়েছে ৭০ শতাংশ আর নবম শ্রেণির ৪৫ শতাংশ। এ দুই শ্রেণির পাঁচ-ছয়টি বই এখনো ছাপা বাকি রয়ে গেছে। তবে এনসিটিবি চাচ্ছে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ষষ্ঠ শ্রেণির ৮০ শতাংশ এবং নবম শ্রেণির ৬০ শতাংশ বই উপজেলায় পৌঁছাতে। বছরের প্রথম দিনে ছোট চার-পাঁচটি বইয়ের সঙ্গে বড় এক-দুটি বই মিলিয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে যাতে তুলে দেওয়া যায়, সেই চেষ্টাই হচ্ছে।
এনসিটিবির বিতরণ নিয়ন্ত্রক মো. হাফিজুর রহমান কালবেলাকে বলেন, ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে বেশিরভাগ বই উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। তবে অষ্টম ও নবম শ্রেণির বই ছাপাখানায় যেতে দেরি হওয়ায় কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে। আশা করছি, অষ্টম ও নবম শ্রেণির বইগুলো ১৫ জানুয়ারির মধ্যে উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছে যাবে।
নিম্নমানের কাগজে বই ছাপানোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এরই মধ্যে তিন-চারটি ছাপাখানার বই কেটে ফেলা হয়েছে। বড় বড় কিছু প্রেসও খারাপ বই দিচ্ছে। এজন্য পরিদর্শন এজেন্টকে শোকজ করা হয়েছে। খারাপ বই যেন কেউ না দিতে পারে, সেই চেষ্টাই চলছে।
বই পাঠানোর সবশেষ চিত্র জানতে কালবেলা আটটি জেলার জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে। তারা জানিয়েছেন, মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বেশিরভাগ বই এলাকায় পৌঁছে গেছে। তবে অষ্টম ও নবম শ্রেণির বই এখনো ঠিকমতো যায়নি। এসব জেলায় এ দুই শ্রেণির বই এখনো ৩০-৪০ শতাংশ যায়নি।
রাঙামাটি জেলার জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মৃদুল কান্তি তালুকদার কালবেলাকে বলেন, রাঙামাটির ১০ উপজেলার মধ্যে দুটিতে অষ্টম শ্রেণির বই এসেছে। তবে নবম শ্রেণির বই আমরা এখনো পাইনি। পঞ্চগড়ের জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাইফুল মালেক বলেন, জেলায় মাধ্যমিকের বই এসেছে ৪৬ শতাংশ। এর মধ্যে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বই বেশিরভাগই চলে এসেছে। তবে অষ্টম ও নবম শ্রেণির বই এসেছে আংশিক। এ ছাড়া দাখিল পর্যায়ের ৭৫ শতাংশ ও কারিগরির বই এসেছে ৪০ শতাংশ।
নোয়াখালীর জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা নুর উদ্দিন মো. জাহাঙ্গীর বলেন, মাধ্যমিকের বই এসেছে ৭০-৭৫ শতাংশ। তবে দুটি উপজেলার একটিতে অষ্টম এবং অন্যটিতে অষ্টম ও নবম শ্রেণির বই এখনো আসেনি। হবিগঞ্জের জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ রুহুল্লাহ বলেন, মাধ্যমিকে ৬০ শতাংশ বই এসেছে। না আসা বেশিরভাগ বই অষ্টম ও নবম শ্রেণির। রংপুরের জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. এনায়েত হোসেনও জানিয়েছেন, তার জেলায় মাধ্যমিকের অষ্টম ও নবম শ্রেণির বই আংশিক গিয়েছে। কক্সবাজার ও ফেনী জেলায়ও এ দুই শ্রেণির বই কম যাওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।
এনসিটিবি কর্মকর্তারা বলছেন, বছর শেষ হওয়ার এক মাস আগে পাঠ্যপুস্তক শাখার সদস্য ও বিতরণ নিয়ন্ত্রক পরিবর্তন করা হয়েছে, যা মোটেই ঠিক হয়নি। এজন্য এনসিটিবিকে বই ছাপাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। নতুন বিতরণ নিয়ন্ত্রক এখনো সবকিছু বুঝে উঠতে পারেননি। আবার পাঠ্যপুস্তক শাখার সদস্যের পদ ফাঁকা রয়েছে। এ কারণে অর্থ শাখার সদস্য মুনির হোসেন খানকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি মো. রাব্বানী জব্বার বলেন, এবার পাণ্ডুলিপি তৈরিতে অনেক দেরি হয়েছে। এমনকি গত সপ্তাহেও নবম শ্রেণির কিছু বইয়ের পাণ্ডুলিপি এসেছে। যে কারণে চুক্তি ও কার্যাদেশে দেরি হয়েছে। স্বাভাবিক কারণেই বই ছাপাতেও দেরি হচ্ছে।
এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, প্রাথমিক, মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির সব বই উপজেলায় পৌঁছে গেছে। তবে অষ্টম ও নবম শ্রেণির বই নিয়ে কিছুটা বিপাকে পড়েছি। এ দুই শ্রেণির সব বই উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছাতে ৭-১০ দিন দেরি হতে পারে। বড় কিছু ছাপাখানা এ দুই শ্রেণির বেশিরভাগ বই ছাপানোর কাজ পেয়েছে। তারাও কিছুদিন সময় চেয়েছেন।
তিনি বলেন, ছাপাখানাগুলো ঠিক সময়ে বই না দিলে সেগুলোকে কালো তালিকাভুক্ত করা হবে। আবার খারাপ কাগজে বই ছাপানোর অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এজন্য পরিদর্শন এজেন্টকে শোকজ করা হয়েছে। ছাপাখানাকেও শোকজ করা হবে। বই বুঝে পেয়ে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, বই পাঠাতে খুব বেশি সংকট নেই। তবে নির্বাচন কেন্দ্র করে খারাপ পরিস্থিতি তৈরির আশঙ্কা দেখা দিলে পুলিশের সহায়তা নেব।
পাণ্ডুলিপি তড়িঘড়ি করে ছাপাখানায় পাঠানোয় ভুলভ্রান্তি হতে পারে কি না—জানতে চাইলে এনসিটিবি চেয়ারম্যান বলেন, বানান ভুল পরিমার্জনীয়। কিন্তু তথ্যগত বা উপস্থাপনাগত কোনো ভুল হয় কি না, সেই ভয়ে আছি। যদি কোনো ভুল ধরা পড়ে, দ্রুততার সঙ্গে সেটি সংশোধন করে মার্চের মধ্যেই সংশোধনী পাঠিয়ে দেব।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ কালবেলাকে বলেন, শিক্ষামন্ত্রী যেহেতু সংসদ সদস্য প্রার্থী, সে কারণে নির্বাচন কমিশন সেটি বন্ধ ঘোষণা করেছে। আর আমাদের মন্ত্রী যেহেতু সংসদ সদস্য প্রার্থী নন, সে কারণে আমাদের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ঢাকায় তার কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিও নেই। সে কারণে প্রাথমিকের বই উৎসব পূর্বঘোষণা অনুযায়ী নির্দিষ্ট স্থানে অনুষ্ঠিত হবে।
এনসিটিবি সূত্র জানিয়েছে, বই উৎসব না হলেও ৩১ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের শাপলা হলে সব স্তরের শিক্ষার্থীর হাতে বই তুলে দেবেন শেখ হাসিনা। সেখানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ১৫ জন, এনসিটিবির ৮ জন, বরেণ্য ১৫ জন শিক্ষাবিদের পাশাপাশি ঢাকা, জগন্নাথ, ইসলামি আরবি ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা থাকবেন। তবে মন্ত্রীরা উপস্থিত থাকলেও বক্তব্য দিতে পারবেন না।