রাজধানীর উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) পাঁচটি মার্কেটের একাধিক ভবনে ১০ বছর ধরে কয়েক হাজার মানুষ জীবন বাজি রেখে পণ্য কেনাবেচা করে আসছেন। যে কোনো সময় ভবনগুলো ধসে পড়তে পারে। কিন্তু এ নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে কোনো ভয়ভীতি নেই বললেই চলে। তবে আতঙ্ক নিয়েই এসব মার্কেটে আসেন ক্রেতারা। পাকিস্তান ও এরশাদ সরকারের আমলে তৈরি এসব ভবনের বেশিরভাগই অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। আইন অনুযায়ী এসব মার্কেট থেকে সিটি করপোরেশন কোনো রাজস্ব আদায় করছে না। এরপরও ভবন ভাঙার সিদ্ধান্ত ঝুলে আছে। যে কোনো সময় এসব ভবন ধসে ঘটতে পারে ভয়াবহ দুর্ঘটনা।
২০১৩ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ডিএনসিসির পাঁচটি মার্কেটকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা দেয়। ঘোষণার সাত বছর পর অর্থাৎ তিন বছর আগে ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ এসব ভবন ভাঙার সিদ্ধান্ত নিলেও এখনো তা বাস্তবায়িত হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, সম্পত্তি বিভাগের একটি চক্র চায় না এসব ভবন ভাঙা হোক। ডিএনসিসির বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন বাজারে দাঁড়িয়ে আছে ঝুঁকিপূর্ণ এই পাঁচটি বিশাল ভবন। এগুলোর অবস্থান হচ্ছে—রায়ের বাজার কাঁচা ও পাকা মার্কেট, গুলশান-২-এর গুলশান কাঁচা মার্কেট (উত্তর), গুলশান-১-এ গুলশান পাকা মার্কেট (দক্ষিণ), কারওয়ান বাজার কাঁচা মার্কেট (কিচেন মার্কেট), কারওয়ান বাজার ১ নম্বর ভবন মার্কেট, কারওয়ান বাজার ২ নম্বর ভবন মার্কেট ও কারওয়ান বাজার আড়ত ভবন। ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষিত হওয়ার পরও এক দশক ধরে দাঁড়িয়ে আছে ভবনগুলো। ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষিত হওয়ার পর এ পর্যন্ত শুধু গাবতলীর আমিনবাজার ট্রাক টার্মিনাল ভবনটি ভাঙতে সক্ষম হয়েছে ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ।
তিন বছর আগে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগ কর্তৃক গঠিত সিটি করপোরেশনের কনডেমনেশন কমিটি এসব ভবন পরিত্যক্ত ঘোষণার অনুমোদন দেয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সিটি করপোরেশন এসব ভবন ভাঙার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। সে সময় ডিএনসিসি জানায়, শিগগির ভবনগুলো ভাঙা হবে। তবে তা আজও বাস্তবায়িত হয়নি।
এ বিষয়ে ডিএনসিসির প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল বাকীর কাছে জানতে চাইলে তিনি কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তবে এক কর্মকর্তা বলেন, এখান থেকে করপোরেশন কোনো রাজস্বও পাচ্ছে না; কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ এসব ভবন ভাঙাও হচ্ছে না।
সরেজমিন দেখা গেছে, ঝুঁকিপূর্ণ এসব ভবনের কোনো কোনোটিতে বাঁশ দিয়ে ছাদ ভেঙে পড়া ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে। কোনো কোনো ভবনের পলেস্তারা খসে পড়েছে। ভেতরের ইট দেখা যাচ্ছে। রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকায় রায়ের বাজার ভাঙাচোরা কাঁচাবাজার ভবনে ৫৩৩টি দোকান রয়েছে। এ বাজারের অবস্থা সবচেয়ে ভয়াবহ। দোকানপ্রতি ৭ থেকে ১০ হাজার টাকা ভাড়া নেন মালিকরা।
এই বাজারের ফল ব্যবসায়ী মো. আবু ছাঈদ জানান, তিনি দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে এখানে ব্যবসা করছেন। ২০ বছর ধরেই দেখছেন বাজারের এই বেহাল অবস্থা। বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েও কোনো লাভ হয় না। মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বিদ্যুৎ সংযোগের ব্যবস্থা করে দেন। কয়েক মাস পর পর সিটি করপোরেশনের লোকজন এসে নতুন করে ভবন নির্মাণের কথা বলে। কিন্তু কাজ আর শুরু হয় না। বাজারে কেনাকাটা করতে আসা স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল জাব্বার জানান, ধানমন্ডির রায়ের বাজারের এ কাঁচাবাজারটি অনেক পুরোনো। ঝুঁকি নিয়েই এখানে বাজার করতে আসি।
ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষিত হওয়ায় এসব মার্কেট থেকে ডিএনসিসি কোনো রাজস্ব আহরণ করে না। এসব ভবনের গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি বা সব ধরনের ইউটিলিটি সার্ভিস লাইনের সংযোগও বারবার বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। এমনকি এসব ভবন সংস্কারে কোনো অর্থও ব্যয় করে না ডিএনসিসি। তার পরও এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে মার্কেটগুলো সচল আছে। অভিযোগ আছে, ডিএনসিসির সম্পত্তি বিভাগের একটি চক্র এসব ভবন ভাঙতে চায় না। তারা এসব ভবনে ব্যবসায়ীদের অন্যত্র সরাতে কোনো উদ্যোগ তো নিচ্ছে না, উল্টো এসব ব্যবসায়ীর কাছ থেকে প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বলে জানা গেছে।
ডিএনসিসির সম্পত্তি বিভাগ থেকে জানা যায়, গুলশান-২ নম্বরের কাঁচা মার্কেটের নিচতলার মাছ ও মাংসের বাজারের অংশটি সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। এই অংশ দ্রুত ভাঙার সুপারিশ করা হয়েছে। গুলশান ১ নম্বরের পাকা মার্কেটে ২০১৭ সালে আগুন লাগার পর সেটি ব্যবহারের অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। সে সময় এটি ভেঙে ফেলা অথবা সংস্কারের সুপারিশ করে তদন্ত কমিটি। তবে ব্যবসায়ীরা সরেননি। এই বাজার-সংলগ্ন দোতলা পাকা মার্কেটটিও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক ও নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে কোনো ধরনের ব্যবসা করতে দেওয়ার কথা না। এসব ভবনে ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি ক্রেতাদেরও ঝুঁকি রয়েছে। সিটি করপোরেশনকে উদ্যোগী হয়ে দ্রুত এসব স্থানে ব্যবসা বন্ধ করতে হবে। যেহেতু তারা রাজস্বই পাচ্ছে না, তাই তাদের উচিত ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো ভেঙে সেখানে নতুন করে নির্মাণ কাজে হাত দেওয়া।
কর অঞ্চল-৫-এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মোতাকাব্বির আহমেদ বলেন, সেপ্টেম্বর ২০২২ থেকে এসব ভবনের রাজস্ব নেওয়া হচ্ছে না। শিগগির নতুন ভবন তৈরি করে করপোরেশন এ সমস্যার দ্রুত সমাধান করবে। তবে এসব ভবনে ব্যবসা পরিচালনা করতে করপোরেশনের কোনো কর্মকর্তা সহযোগিতা করছে—এমনটি মনে হয় ঠিক না।
এ বিষয়ে সম্প্রতি মেয়র আতিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের নিজস্ব ফান্ড নেই। পুঁজিবাজার থেকে ফান্ড নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। করপোরেশনের দুটি মার্কেট নিয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টের সঙ্গে এরই মধ্যে চুক্তি করেছি। তারা ডিজাইন করবেন। এরপর রয়েছে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার এবং ফান্ডিংয়ের বিষয়। প্রথমে রায়েরবাজার এবং গুলশানের ২ নম্বরের মার্কেটের কাজ শুরু হবে।