আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতিতে নানামুখী মেরুকরণ হচ্ছে। নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দলই নানাভাবে ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করছে। নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ সরকারবিরোধী অধিকাংশ দল। অবিলম্বে ক্ষমতাসীন সরকারের পদত্যাগ, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে কর্মসূচি পালন করে আসছে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ কয়েকটি ইসলামপন্থি দল। এবার সিইসির পদত্যাগ ও নির্বাচন কমিশন বাতিল এবং নির্বাচনকালীন জাতীয় সরকার গঠনের দাবিতে তৃণমূলে কর্মসূচি দিয়ে ফের মাঠে সক্রিয় থাকতে চায় ইসলামী আন্দোলন। এ দাবিতে আগামীকাল শনিবার নতুন কর্মসূচি দেবেন দলটির আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম (চরমোনাই পীর)। নতুন কর্মসূচির মধ্যে জেলা পর্যায়ে বিক্ষোভ সমাবেশ এবং ঢাকায় সমাবেশসহ অন্যান্য কর্মসূচি আসতে পারে। এর আগে ২১ জুন নির্বাচন কমিশন কার্যালয় অভিমুখে গণমিছিল এবং বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট উত্তরণের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি এবং দেশের শীর্ষ ওলামা মাশায়েখ, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে ২৪ জুন মতবিনিময় সভা করেছে দলটি। এ ছাড়া সম্প্রতি সুইডেনে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআন শরীফ পোড়ানোর প্রতিবাদে আজ শুক্রবার বাদ জুমা রাজধানীর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ মিছিল করবে ইসলামী আন্দোলনসহ বেশ কয়েকটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল।
জানা যায়, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে অটল থাকলেও নির্বাচনের প্রস্তুতিও সারছে ইসলামী দলগুলো। আগামী জাতীয় নির্বাচনে ধর্মভিত্তিক ইসলামী দলগুলোর কোন দল কী অবস্থানে থাকবে, তা এখনো অস্পষ্ট। বিএনপির সঙ্গে রাজপথে না থাকলেও আন্দোলনের সফলতা ও দাবি আদায়ের বিষয়ে বিএনপির দিকেই তাকিয়ে আছেন ইসলামী দলগুলোর নেতারা। বিএনপি যদি নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায়ে সরকারকে চাপে ফেলতে পারে, তাহলে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর অবস্থান হবে একই রকম। আর বিএনপি যদি নির্বাচনে অংশ না নেয়, তাহলে অবস্থান হবে আরেক রকম।
১৮ জুন সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে চরমোনাই পীর বলেছিলেন, দেশে বর্তমানে ভোটের পরিবেশ নেই। সরকার তাদের জোটে যাওয়ার জন্য ডাকলেও সাড়া দেব, এটা ভাবার সুযোগ নেই। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও ইসলাম রক্ষার জন্য পরে আমরা যা করার তাই করব এবং মিডিয়াকে জানাব। তিনি বলেন, অতীতের নির্বাচনগুলোয় আমরা কেবল যে নির্বাচনে সরকার পরিবর্তন হয় না সেগুলোতে অংশ নিয়েছি, যারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলে তাদের কেউ আবার হেরে গেলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরোধিতা করেন। সেজন্যই আমরা জাতীয় সরকারের কথা বলি।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতা কালবেলাকে জানান, রাতের ভোটে নির্বাচিত বর্তমান সংসদের কোনো নৈতিক বৈধতা নেই। ক্ষমতাসীনরা আবারও জাতীয় সংসদ বহাল রেখে গায়ের জোরে তাদের অধীনেই একটি নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন করতে চায়; কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা হলো—জাতীয় সংসদ বহাল রেখে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে, সেই নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে না। বরং আবারও ২০১৪ ও ২০১৮ এর মতো নির্বাচনের নামে প্রহসন হবে। এই অবৈধ সংসদ বহাল রেখে কোনো নির্বাচন দেশবাসী মেনে নেবে না। অতএব, আমরা বর্তমান সংসদ ভেঙে দিয়ে পরের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনকালীন জাতীয় সরকারের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন চাই। সেইসঙ্গে অবিলম্বে সরকারের পদত্যাগ ও জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়ার দাবি জানাই।
এসব দাবিতেই নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করবে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। আগামীকাল সকালে রাজধানীর পুরোনো পল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সাংগঠনিক সভা আহ্বান করা হয়েছে। এতে দলের কেন্দ্রীয় নেতা, অঙ্গ-সংগঠনের শীর্ষ নেতা এবং ঢাকার পার্শ্ববর্তী কয়েকটি জেলার শীর্ষ নেতারা উপস্থিত থাকবেন। সেখানে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা শেষে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা দেবেন সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান, যিনি সদ্য অনুষ্ঠিত গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলের মেয়রপ্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। জানতে চাইলে গতকাল বৃহস্পতিবার তিনি কালবেলাকে বলেন, এমনিতেই শুক্রবার (আজ) ঢাকায় আমাদের বিক্ষোভ সমাবেশ হবে। চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসন এবং অবাধ, গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে নির্বাচনকালীন জাতীয় সরকার গঠনের লক্ষ্যে জনমত তৈরির জন্য কর্মসূচি থাকবে। শনিবার ঢাকায় আমাদের আমির (চরমোনাই পীর) আসছেন। তিনি দলীয় সভায় নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করবেন। প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনে যাব না। কারণ বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে গেলে কী হবে, সেটা বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরিষ্কার হয়ে গেছে।
ইসলামী আন্দোলনের মিডিয়া ও প্রচার বিভাগের সমন্বয় সহকারী শহীদুল ইসলাম কবির বলেন, আমরা অবিলম্বে সিইসি হাবিবুল আউয়ালের পদত্যাগ এবং নির্বাচনকালীন জাতীয় সরকার চাই। তিনি আরও বলেন, এ দাবিতে আগামীকাল আমাদের আমির (চরমোনাই পীর) সাংগঠনিক সভায় নতুন কর্মসূচি দেবেন। আমরা চাই একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন।
এ ছাড়াও জানা যায়, অধিকাংশ ইসলামী দল দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে। দলগুলোর দায়িত্বশীল নেতারা জানিয়েছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন ঘিরে তাদের ওপর সরকারি মহলের শক্ত নজরদারি রয়েছে, যাতে ইসলামী দলগুলো কোনোভাবেই বিএনপির দিকে ঝুঁকে না পড়ে। আর নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৪০টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ধর্মভিত্তিক ইসলামী দল ১০টি। তন্মধ্যে কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক দল ছয়টি। এগুলো হচ্ছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও খেলাফত মজলিস। এর মধ্যে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ছাড়া বাকি পাঁচটি দলই একসময় বিএনপির সঙ্গে জোটে ছিল। এখন এ দলগুলোর মূল কোনো অংশই বিএনপির সঙ্গে নেই। জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও ইসলামী ঐক্যজোট নামে দুটি খণ্ডিত অংশ বিএনপির সঙ্গে আছে, যাদের নিবন্ধন নেই। নিবন্ধনের বাইরে সবচেয়ে শক্তিশালী ইসলামী দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। ইতিমধ্যে ১০ জুন ঢাকায় সমাবেশ করার মাধ্যমে ফের রাজনীতিতে নতুনভাবে আলোচনা তৈরি করেছে দলটি। এখন দেশের বিভাগীয় শহরগুলোতে সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জামায়াতে ইসলামী।
মন্তব্য করুন