জনি রায়হান
প্রকাশ : ১০ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১০ জুলাই ২০২৩, ০৯:২১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সাক্ষাৎকার

সঞ্জীবনী সুধার জীবন যেমন

সঞ্জীবনী সুধা। কালবেলা
সঞ্জীবনী সুধা। কালবেলা

পদে পদে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, হাসি-ঠাট্টা আর অবজ্ঞা সব সময়ই ছিল তার নিত্যসঙ্গী। স্কুলে ভর্তির পর থেকেই শিকার হন বৈষম্যের। প্রথম ক্লাসেই তাকে বসতে দেওয়া হয় আলাদা বেঞ্চে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েও শিকার হতে হয়েছে হয়রানির। তবে বাবার সহযোগিতা ও মায়ের সাহস তাকে নিয়ে গেছে অনন্য এক উচ্চতায়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষে তিনি এখন চাকরি করছেন একটি বেসরকারি ব্যাংকে। নিজের নাম পরিবর্তন করে আশিকুল ইসলাম সজীব থেকে হয়ে গেছেন সঞ্জীবনী সুধা। শুধু তাই নয়, প্রথম ট্রান্সজেন্ডার নারী হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমফিল করতে যাচ্ছেন তিনি।

২০২১ সালে একটি বেসরকারি ব্যাংকে ‘কমিউনিকেশন অ্যান্ড সিএসআর অফিসার’ হিসেবে যোগ দেন সঞ্জীবনী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমফিলের পর পিএইচডি করারও ইচ্ছে রয়েছে সুধার। আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ারও স্বপ্ন। কালবেলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নিজের জীবনযুদ্ধের গল্প শুনিয়েছেন সঞ্জীবনী সুধা।

শক্তির উৎস বাবা-মা : সুধার বাড়ি টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলায়। পরিবারে আছেন বাবা, মা ও ছোট এক বোন। জীবনযুদ্ধের প্রতিযোগিতায় বাবা-মা ছিলেন সুধার সব থেকে বড় শক্তির উৎস। যতবার ভেঙে পড়েছেন, মানসিকভাবে সাহস জুগিয়েছেন মা। আর বাবা ছিলেন তার যুদ্ধের একমাত্র ঢাল। সঞ্জীবনী বলেন, ‘আমার বাবা ছিলেন একজন স্কুলশিক্ষক আর মা গৃহিণী। আমার জন্মের পর আচরণ ছিল অন্যরকম। আমাকে ছেলে মনে করত পরিবার; কিন্তু আমি নিজেকে ভাবতাম ছোট বোনের মতো মেয়ে হিসেবে। বিষয়টি বাবা-মা প্রথমে ভালোভাবে নিচ্ছিলেন না; কিন্তু যখন তারা উপলব্ধি করতে পারলেন একজন সন্তান হিসেবে সমাজে এগিয়ে যেতে তাদের সহযোগিতা আমার সব থেকে বেশি প্রয়োজন, তখন তারা ঢালের মতো আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন।’

স্কুলের প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা ভয়াবহ : স্কুলজীবনের প্রথম দিনের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে বার বার চোখে পানি চলে আসছিল সুধার। কারণ সব থেকে বেশি তিনি স্কুল ও কলেজের সহপাঠীদের কাছে হেনস্তার শিকার হয়েছেন। সঞ্জীবনী বলেন, ‘আমাকে যদি বলা হয় প্রথম দিনের স্কুল নিয়ে একটি রচনা লিখ। আমি তা লিখতে পারি না। ৬ বছর বয়সে আমার বাবা যখন আমাকে স্কুলে নিয়ে যান, তখন আমার আচরণ, কথা বলার ধরন দেখে আমার শিক্ষিকা ছেলেমেয়ের বেঞ্চে না বসিয়ে আমাকে আলাদা করে বসান। বসিয়ে দিয়ে পরে বলেন, তুমি ওদের সঙ্গে বসবে না। সব সময়ই আলাদা বসবে। আসলে তখনই আমাকে পৃথক করা হয়ে গেছে। সেটা আমি এখন পর্যন্ত লালন করছি। এরপর থেকে সহপাঠী, শিক্ষক ও শিক্ষিকা সবাই আমার সঙ্গে আলাদা রকমের আচরণই করত।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি কিছুটা মধুর: স্কুল-কলেজে যেভাবে হেনস্তার শিকার হয়েছিলেন সঞ্জীবনী তার চেয়ে কিছুটা কম হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে। শিক্ষক ও সহপাঠীদের বেশ সহযোগিতা পেয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘২০১২ সালে যখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই, তখনো অনেকে এটা ভাবতেও পারত না। যখন আমি হেঁটে যেতাম সবাই হা করে তাকিয়ে থাকত। তবে হাই স্কুল-কলেজের যে জীবন ছিল তার চেয়ে কিছুটা স্বস্তিতে ছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। অনেকের সহযোগিতা পেয়েছি।’

যৌন নির্যাতনের শিকার: স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বহুবার শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন সঞ্জীবনী। সেসব ভয়নক স্মৃতি এখনো পিছু ছাড়েনি তার। সঞ্জীবনী বলেন, ‘বহুবার এমন নির্মমতার সম্মুখীন হয়েছি আমি। সহপাঠী, বন্ধু ও আশপাশের মানুষের দ্বারাই এসব ঘটনা ঘটেছে; কিন্তু সব কিছুর তো একটা মাত্রা থাকে। আমার ক্ষেত্রে সেটা অতিমাত্রায় হয়েছে, জঘন্যভাবে হয়েছে, যা বর্ণনা করাও কঠিন।’

হরমোনাল পরিবর্তন ছিল দুর্বিষহ কষ্টের: বয়ঃসন্ধিকালে পা রাখার সময়টা অনেক বেশি দুর্বিষহ এবং চ্যালেঞ্জিং ছিল সঞ্জীবনীর। সেই অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে আমি নিজেকে নারীই মনে করতাম; কিন্তু যখন বয়ঃসন্ধিকাল শুরু হলো, তখন দেখা গেল আমার বিভিন্ন হরমোনাল পরিবর্তন আসা শুরু করল। আমাদের যে পরিবর্তনটা হয় একেবারে অন্য রকমের। না সেটা একজন মেয়ের মতো, না একজন পুরুষের মতো। আমি কথা বলার সময় একজন ছেলেও পেছনে তাকায় আবার একজন মেয়েও পেছনে তাকায়। এটি খুবই দুর্বিষহ ব্যাপার ছিল।’

যেভাবে হলো লিঙ্গ পরিবর্তন: লিঙ্গ পরিবর্তনের জন্য বেশ কিছু প্রসেস ফলো করতে হয়েছে। এ বিষয়ে সুধা বলেন, ‘এটা একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এটা এক দিনে সম্ভব হয় না। আমরা যারা করেছি তাদের ওষুধ সেবন করতে হয় আজীবন। কিংবা হরমোন নিতে হয় সারাজীবন। এটা বলা যায় যে, এই প্রক্রিয়ার মধ্যে যেতে হবে আমাকে।’

১২০০ লাশ গোসল দিয়েছেন সঞ্জীবনী: মানুষ মানুষের জন্য। এ স্লোগানকে খুব ছোটবেলা থেকে বুকে লালন করেছেন সঞ্জীবনী। সব সময় মানুষের জন্য কাজ করে যান তিনি। করোনা মহামারির সময় মানুষের দাফন-সৎকারের কাজে তিনি স্বেচ্ছায় যুক্ত হন। এরপর প্রায় ১২শ মানুষের লাশ গোসল দিয়েছেন সঞ্জীবনী। তিনি বলেন, করোনাকালে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে আমি লাশ গোসল ও সৎকারের কাজে যুক্ত হই। ১২০০-এর বেশি মানুষের লাশ গোসল দিয়েছি আমি। তবে লাশের গোসল করানোর সময়ও বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছে।

দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিতে চাই : ট্রান্সজেন্ডারদের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিতে চান সঞ্জীবনী সুধা। একজন মানুষ হিসেবে সম্মান পাওয়ার অধিকারটুকু সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে চান তিনি। খুলে দিতে চান ট্রান্সজেন্ডারদের জন্য সমাজের রুদ্ধ দুয়ার। জবাব দিতে চান সব অবজ্ঞার। সুধা বলেন, ‘আমি আমার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মানুষের সঙ্গে মানুষের যে ভালোবাসাবোধ, সেটাই দেখতে চাই। আমাদের প্রত্যেকেরই দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। আমরা নারী, পুরুষ, ট্রান্সজেন্ডার সবাইকে নিয়েই সুন্দর একটি দেশ গড়তে এগিয়ে যেতে চাই। সুন্দর সব সময়ই সুন্দর।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

চলে গেলেন হলিউড কিংবদন্তি ডায়ান কিটন

সমাধান ও সফটওয়্যার শপের মধ্যে নতুন চুক্তি

১০০ আসনে প্রাথমিক মনোনয়ন ঘোষণা করতে যাচ্ছে এবি পার্টি

পাক সীমান্তে ট্যাঙ্ক ও ভারী অস্ত্র মোতায়েন আফগানিস্তানের

তিন মন্ত্রণালয়ের ৩ সচিবকে বদলি

নতুন ধর্ম সচিব কামাল উদ্দিন

খুলনায় শিশু হত্যায় জড়িত ফয়সালের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ

শিশু মিমের চিকিৎসার দায়িত্ব নিলেন শিমুল বিশ্বাস

পুয়ের্তো রিকো ম্যাচের আগে দুঃসংবাদ পেল আর্জেন্টিনা

পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনসহ ৫ দাবিতে ঢাকার ডিসিকে জামায়াতসহ ৭ দলের স্মারকলিপি

১০

ট্রুডোর সঙ্গে প্রমোদতরীতে ঘনিষ্ঠ কেটি পেরি

১১

রাবিতে ফারুক হত্যা মামলার সব আসামি বেকসুর খালাস

১২

সড়ক দুর্ঘটনায় আহত বাবাকে বাঁচাতে চান হাবিপ্রবির সালমা

১৩

রাতের অন্ধকারে ভোট চাই না : সিইসি

১৪

খাওয়ার পর বসে থাকার অভ্যাস ধূমপানের মতোই বিপজ্জনক

১৫

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে লাইভ চলাকালে ফেসবুক পেজে সাইবার হামলা

১৬

পাকিস্তানের ৫৮ সেনা নিহত, দাবি আফগানিস্তানের

১৭

‘পরোয়ানা জারি হওয়া সেনা কর্মকর্তাদের বিচারের ক্ষমতা রয়েছে ট্রাইব্যুনালের’

১৮

দু-তিন দিন ধরে ফ্ল্যাট বন্ধ, পুলিশ এসে উদ্ধার করল পাঁচটি মৃতদেহ

১৯

‘বৈষম্য আর আধিপত্যবাদের আগ্রাসন থেকে সেফ এক্সিট দরকার’

২০
X