সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে জিম্মি জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহর ২৩ নাবিকের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে জেগেছে আশার আলো। অপহরণের প্রায় ৯ দিন পর জাহাজের মালিক পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে জলদস্যুরা। এতে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে নাবিকদের স্বজনদের মধ্যে। তাদের চাওয়া ঈদের আগেই যেন নাবিকরা বাড়ি ফিরে আসেন।
তৃতীয় একটি পক্ষের মাধ্যমে গত বুধবার দুপুরে জলদস্যুরা এমভি আব্দুল্লাহর মালিক প্রতিষ্ঠান কবির গ্রুপের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তবে তৃতীয় পক্ষটি কে, তা খোলাসা করা হয়নি। আর প্রথমবারের মতো কথা হলেও কোনো ধরনের মুক্তিপণ চাওয়া হয়নি বলেও জানিয়েছে কবির গ্রুপের মিডিয়া ফোকাল পারসন মিজানুল ইসলাম। কালবেলাকে তিনি বলেন, দস্যুদের যোগাযোগের অর্থ নাবিকদের মুক্তির প্রক্রিয়া শুরু। এখন তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে আলাপ-আলোচনা এবং মুক্তিপণ নিয়ে চলবে দরকষাকষি।
এমভি আব্দুল্লাহর চিফ অফিসার আতিক উল্লাহ খানের শ্বশুর মোহাম্মদ ফরহাদ বলেন, এটি ভালো খবর। নাবিকদের পরিবারের জন্য স্বস্তিদায়ক। আতিক উল্লাহর মা কালবেলাকে বলেন, জাহাজ মালিকরা জানিয়েছেন, শান্তির মাধ্যমে তারা চেষ্টা করছেন নাবিকদের ফিরিয়ে আনতে। টাকা লাগলে তারা দেবেন। কিন্তু কারও কোনো ক্ষতি যেন না হয়।
জলদস্যুরা যোগাযোগ করেছে—এ খবর শুনে আমাদের ভালো লাগছে। আশা করি, খুব দ্রুত তারা ফিরে আসবে।
আতিক উল্লাহর মেজো মেয়ে বলেন, শুনেছি বাবাকে একটি খারাপ গ্রুপ অপহরণ করেছে। আমি চাই বাবা দ্রুত ফিরে আসুক। আমরা একসঙ্গে ঈদ করব, অনেক মজা করব। বাবা যেন নিরাপদে আসতে পারেন তার জন্য দোয়া করবেন।
এমভি আব্দুল্লাহর বহরে আছেন নাবিক হোসেন মো. সাজ্জাদ (২৯)। তিনি চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার বৈরাগ ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের মো. তাজু মিয়ার ছেলে। তার জিম্মিদশার পর থেকেই চরম দুশ্চিন্তায় স্বজনরা। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে সাজ্জাদ তৃতীয়। জাহাজে ওঠার আগের দিনই তার কাবিন সম্পন্ন হয়।
কথা হয় সাজ্জাদের মেজো ভাই মোশাররফ মীরের সঙ্গে। কালবেলাকে তিনি বলেন, আমার ছোট ভাই সর্বশেষ গত ১২ মার্চ সন্ধ্যা ৬টা ৪৭ মিনিটে একটি অডিও রেকর্ড পাঠায়। মাত্র ৯ সেকেন্ডের ওই অডিওতে সে বলে, আমাদের মোবাইল জলদস্যুরা নিয়ে ফেলছে। আর কথা হবে না। এখন আমাদের সোমালিয়ার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এরপর তার সঙ্গে আর যোগাযোগ করতে পারিনি। তাকে নিয়ে আমরা চিন্তিত। সরকার যেন সবাইকে ফিরিয়ে আনতে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়। এরই মধ্যে জাহাজের মালিকদের পক্ষ থেকেও আমাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার জোর চেষ্টা করছেন তারা।
এই বহরে আছেন মোহাম্মদ শামসুদ্দিন (৪০)। আনোয়ারা উপজেলার মধ্যবন্দর সেন্টার এলাকার মৃত আইয়ুব আলীর ছেলে শামসুদ্দিন জাহাজটিতে ওয়েলার পদে কর্মরত। উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছে তার পরিবার। শামসুদ্দিনের ভগ্নিপতি বদরুল ইসলাম বলেন, তিন কন্যাসন্তানের জনক শামসুদ্দিন পরিবারে একমাত্র উপার্জনশীল ব্যক্তি। দুই ভাই, দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট শামসুদ্দিন। স্বজনদের সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয় গত মঙ্গলবার বিকেল ৫টা ৪০ মিনিটে। তখন তিনি মায়ের সঙ্গে কথা বলেন। বলেছিলেন, জলদস্যুরা জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আমাদের জিম্মি করে ফেলেছে। সবার হাতে ভারী অস্ত্র। আমরা ভয়ে আছি। আমাদের জন্য দোয়া করবেন। শুনেছি, জলদস্যুরা জাহাজের মালিকপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। আশা করি আমাদের মধ্যে খুব দ্রুতই ফিরে আসবে শামসুদ্দিন।
এদিকে এমভি আবদুল্লাহর মালিক প্রতিষ্ঠান কবির গ্রুপের মিডিয়া ফোকাল পারসন মিজানুল ইসলাম বলেছেন, দস্যুদের আগের চেয়ে নমনীয় মনে হচ্ছে। মালিকপক্ষ দ্রুততম সময়ের মধ্যে এর সমাধান করার চেষ্টা করবে। আমাদের লক্ষ্য, যে কোনোভাবে নাবিকদের অক্ষত অবস্থায় ফিরিয়ে আনা। জাহাজ ও নাবিকরা জিম্মি হওয়ার পরের আটদিনে জলদস্যুরা যোগাযোগ না করলেও আমরা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে কাজ এগিয়ে রেখেছি। এর আগে আমাদের প্রতিষ্ঠানের জাহাজ এমভি জাহান মণি ১০০ দিন পর দস্যুদের কবল থেকে ২৫ নাবিকসহ ২৬ জনকে নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনতে আমরা সক্ষম হয়েছি। সে অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। আশা করছি এবারও সমঝোতার মাধ্যমে ২৩ নাবিকসহ জাহাজটিকে আমরা নিরাপদে ফিরিয়ে আনতে পারব।
যেভাবে মুক্ত হয় এমভি জাহান মণি: ২০১০ সালের ১১ নভেম্বর এমভি জাহান মণি ৪৩ হাজার ১৫০ টন নিকেল আকরিক নিয়ে ইন্দোনেশিয়া থেকে যাত্রা শুরু করে। জাহাজটি সিঙ্গাপুর বন্দরে যাত্রাবিরতি করে। এরপর ২৭ নভেম্বর গ্রিসের উদ্দেশে জাহাজটি রওনা দেয়। ৫ ডিসেম্বর সুয়েজ খালের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় জাহাজটি সোমালিয়ার জলদস্যুদের কবলে পড়ে। তারা জাহাজের গতিপথ পাল্টে নিয়ে যায় সোমালিয়ার দিকে। ১৩ ডিসেম্বর নাবিকদের ছেড়ে দেওয়ার বিনিময়ে মুক্তিপণ দাবি করে। লিওন নামে একজন দস্যুদের পক্ষে দরকষাকষি করেছিল। তারা ৯ মিলিয়ন ডলার দাবি করে। ২০১১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি দস্যুদের সঙ্গে মালিকরা একমত হন।
এমভি জাহান মণি জাহাজে থাকা এক নাবিক বলেন, চূড়ান্ত দরকষাকষির পর ২০১১ সালের ১২ মার্চ একটি বিমানে করে মুক্তিপণের টাকা নেওয়া হয় সোমালিয়ায়। কথামতো ডলার ভর্তি দুটি ওয়াটার প্রুফ স্যুটকেস ছুড়ে দেওয়া হয় সাগরে ভাসা দস্যুদের একটি স্পিডবোটের ওপর। এতে সব ছিল ১০০ ডলারের বান্ডেল। এসব ডলার গুনে নেয় দস্যুরা। এরপর ১৪ মার্চ নাবিকসহ জাহাজটি মুক্ত হয় দস্যুদের কবল থেকে।
এমভি জাহান মণি জাহাজে থাকা নাবিক মোহাম্মদ ইদ্রিস বলেন, জাহান মণি যেভাবে জিম্মি করেছিল একইভাবে এমভি আবাদুল্লাহকেও তারা জিম্মি করেছে। সাগরে
ছোট-মাঝারি ধরনের ফিশিং বোট দিয়ে জাহাজ মণি নিয়ন্ত্রণে নেয় সশস্ত্র দস্যুরা। তবে দিত যতই গড়িয়েছিল, দস্যুদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কও ততই উন্নত হয়। তারা আমাদের কোনো ক্ষতি করেনি। জাহাজে পর্যাপ্ত শুকনো খাবার ছিল। এ ছাড়া মাছ ধরার জন্য তারা আমাদের বড়শি সরবরাহ করেছিল।