ইউক্রেন যুদ্ধের ১৬ মাস চলছে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে যখন এই যুদ্ধ শুরু হয়, তখন বিশ্লেষকরা ভেবেছিলেন কয়েক দিন, বড়জোর কয়েক মাসের মধ্যে এই যুদ্ধের সমাপ্তি হবে। কিন্তু সেটি বছর গড়িয়েছে বেশ কয়েক মাস আগে। যুদ্ধের একদিকে রয়েছে রাশিয়া, অন্যদিকে ইউক্রেন। যুদ্ধে ইউক্রেনকে অর্থ ও সামরিক সরঞ্জাম দিয়ে সহায়তা করে যাচ্ছে পশ্চিমা বিশ্ব। আক্রমণ-প্রতিরোধ, ভবন ধ্বংস, পাওয়ার প্লান্টে হামলা—এতদিন এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল যুদ্ধ। কিন্তু এর মধ্যে হঠাৎ রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলা চালানো শুরু করে ইউক্রেন। এ ঘটনায় ব্যাপক ক্ষিপ্ত হয়ে ইউক্রেনে বড় ধরনের আক্রমণের নির্দেশ দেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। নতুন উদ্যমে ইউক্রেনে হামলা চালানো শুরু করে মস্কো, যার মধ্য দিয়ে চলমান যুদ্ধ নতুন পর্বে প্রবেশ করেছে। চলতি সপ্তাহে খেরসনে নোভা কাখোভকা বাঁধ উড়িয়ে দেওয়া, আগামী মাসে প্রতিবেশী দেশ বেলারুশে রাশিয়ার কৌশলগত পরমাণু অস্ত্র মোতায়েনের ঘোষণা এবং ইউক্রেনের আক্রমণে প্রতিরক্ষা লাইন উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে পুতিনের বক্তব্যে এটি আরও সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। খবর বিবিসি, সিএনএন ও আলজাজিরার।
পুতিন দাবি করেছেন, রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে দীর্ঘ প্রত্যাশিত পাল্টা আক্রমণ শুরু করেছে ইউক্রেনের সেনারা এবং প্রতিরক্ষা লাইন উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। ইউক্রেনের পাল্টা হামলা নিয়ে গত শুক্রবার রাশিয়ার সোচি শহরে প্রথমবার এমন বিরল মন্তব্য করলেন তিনি। ইউরোশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়নের রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেন, আমরা স্পষ্টভাবেই বলতে পারি হামলা শুরু হয়েছে। ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর সামরিক রসদ ব্যবহার দেখেই তা বোঝা যাচ্ছে।
তবে ইউক্রেনের সেনারা যে লক্ষ্যে এই অভিযান শুরু করেছে, তা এখনো অর্জিত হয়নি। তাদের সেনারা বড় ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। তীব্র লড়াইয়ে প্রতি তিনজন ইউক্রেনের সেনার বিপরীতে প্রাণ হারাচ্ছেন একজন রুশ সেনা। প্রতীক্ষিত পাল্টা আক্রমণ শুরু হয়েছে বলে গতকাল শনিবার স্বীকার করেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিও। রুশ নিয়ন্ত্রিত কয়েকটি অঞ্চলে হামলার ঘটনা বেড়েছে। গত কয়েকদিনে দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলীয় ফ্রন্ট লাইনে ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়ছে রুশ বাহিনী। মস্কো দাবি করেছে, ইউক্রেন জাপোরিজিয়া অঞ্চলে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা লাইন ভেঙে ফেলতে এবং দক্ষিণে সরবরাহ লাইন কাটতে বারবার চেষ্টা করেছে।
এদিকে রুশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণ শুরু হয়েছে বলে মনে করছে ওয়াশিংটনভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার (আইএসডব্লিউ)। টুইটে এই থিঙ্ক ট্যাঙ্ক বলছে, ইউক্রেনজুড়ে বিভিন্ন ধরনের সামরিক কর্মকাণ্ড ইঙ্গিত দিচ্ছে, আক্রমণ চলমান রয়েছে। এ বিষয়ে শুক্রবার সকালে ইউক্রেনের উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রী হান্নান মালিয়ার বলেন, দক্ষিণ-পূর্ব জাপোরিজিয়া অঞ্চলে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থানে রয়েছে রুশ বাহিনী। যদিও যুদ্ধের কেন্দ্রস্থল এখন দোনেৎস্ক। লিম্যান, বাখমুত, আভদিভকা ও মারিঙ্কায় ভারী লড়াই চলছে।
গত মঙ্গলবার শক্তিশালী এক বিস্ফোরণে উড়ে যায় ইউক্রেনের খেরসন অঞ্চলে সোভিয়েত আমলে দিনিপ্রো নদীতে নির্মিত বিশাল এক বাঁধ। এ ঘটনায় ইউক্রেনে রুশ দখলকৃত জাপোরিজিয়া অঞ্চলের মেলিতোপোল শহরের মেয়র ইভান ফেদোরভ বলেন, খেরসনে নোভা কাখোভকা বাঁধ উড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে এই যুদ্ধ নতুন পর্বে প্রবেশ করল।
গুরুত্বপূর্ণ এই বাঁধটি কাখোভকা জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের অংশ। বিস্ফোরণে বাঁধটি ভেঙে যাওয়ার পর খেরসনের অনেক অঞ্চলে পানি ঢুকে পড়ে। বিশাল ভূখণ্ড প্লাবিত হয়ে পড়ে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার আশঙ্কা, বাঁধ ধ্বংসের কারণে সেখানে মানবিক বিপর্যয় দেখা দেবে, হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়বেন। রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের সম্ভাব্য পাল্টা আক্রমণের আগে এই ঘটনা ঘটে। এতে নদী পার হয়ে রুশ সেনাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা দিনিপ্রোর নদীর পূর্ব তীরে আক্রমণ চালানো ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর পক্ষে বেশ কঠিন। ইউক্রেন ও ন্যাটো অভিযোগ তুলেছে, রাশিয়া বাঁধটি উড়িয়ে দিয়েছে। রাশিয়া পাল্টা অভিযোগ করে বলেছে, বাঁধটি ভেঙে যাওয়ার জন্য ইউক্রেন দায়ী। ভেস্তে যাওয়া পাল্টা আক্রমণ থেকে মনোযোগ অন্যদিকে সরাতে কিয়েভ এমন নাশকতা চালিয়েছে।
মেলিতোপোল শহরের মেয়র ফেদোরভ আরও বলেন, পুতিন নতুন মাত্রার আগ্রাসন চালাতে প্রস্তুত। কিন্তু আমি জানি আমাদের জিততে হবে। আমরা প্রতিদিন সন্ত্রাসীদের (পুতিন) কাছ থেকে নতুন কিছু আসবে বলে ধারণা করি। কিন্তু এগুলো আমাদের জয় অর্জন থেকে থামাতে পারবে না। যুদ্ধের আগে মেলিতোপোল শহরের লোকসংখ্যা ছিল প্রায় দেড় লাখ। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার সর্বাত্মক আক্রমণ শুরু হওয়ার প্রথম দিকে শহরটি রুশদের দখলে চলে যায়। ফেদোরভকে রুশ গোয়েন্দা সংস্থা বন্দি করে ২০২২ সালের মার্চে। ছয় দিন আটক থাকার পর বন্দিবিনিময়ে মুক্তি পান তিনি।
যুদ্ধ যে নতুন পর্বে প্রবেশ করেছে, তার আরেকটি উদাহারণ হলো—প্রতিবেশী বেলারুশে রাশিয়ার কৌশলগত পরমাণু অস্ত্র মোতায়েনের ঘোষণা। শুক্রবার পুতিন জানান, যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্ররা রাশিয়াকে মাথানত করতে বাধ্য করার জন্য ইউক্রেনে ক্রমাগত অস্ত্র সরবরাহ করে এই প্রক্সি ওয়ারের বিস্তার ঘটিয়ে চলেছে। আগামী ৭-৮ জুলাইয়ের মধ্যে বিশেষ অস্ত্রভান্ডার প্রস্তুত হয়ে যাবে। তার পরই সেগুলো বেলারুশে মোতায়েন শুরু হবে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর এই প্রথম রাশিয়া নিজ ভূখণ্ডের বাইরে কোথাও পরমাণু অস্ত্র মোতায়েন করতে যাচ্ছে। গত মার্চে পুতিন ঘোষণা দেন, মিত্রদেশ বেলারুশে কৌশলগত পরমাণু অস্ত্র মোতায়েন করা হবে।
৭০ বছর বয়সী পুতিন ইউক্রেন যুদ্ধকে ন্যাটোর ক্রমাগত বিস্তারের বিরুদ্ধে রাশিয়ার অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই বলে মনে করেন। তিনি বারবার পশ্চিমাদের সতর্ক করে বলেছেন, মস্কো কিছুতেই পিছু হটবে না। এদিকে, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিও পণ করেছেন, ইউক্রেনের ভূখণ্ড থেকে শেষ রুশ সেনাকে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত তারা থামবেন না। এমনকি ২০১৪ সালের যুদ্ধে রাশিয়ার দখল করে নেওয়া ক্রিমিয়াও তারা উদ্ধার করবেন।
বেলারুশে পুতিনের পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েনের বিষয়টি গভীর মনোযোগের সঙ্গে লক্ষ্য করছে যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্ররা। চীনও নীরবে বিষয়টির ওপর নজর রাখছে। যুদ্ধে পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহারের ভয়াবহ পরিণামের বিষয়ে বেইজিং বারবার সব পক্ষকে সতর্ক করে যাচ্ছে।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার নেতারা একযোগে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বিভিন্ন স্থানে মোতায়েন করা পরমাণু অস্ত্রগুলো অস্ত্রাগারে ফিরিয়ে আনে। পরমাণু অস্ত্রগুলো ওই সময় সদ্য স্বাধীন হওয়া ইউক্রেন, কাজাখস্তান ও বেলারুশে মোতায়েন ছিল। এখন পর্যন্ত যুদ্ধে প্রতিপক্ষের ওপর শুধু যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহার করেছে। ১৯৪৫ সালে দেশটি জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে পরমাণু হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র।
মন্তব্য করুন