গামা রশ্মি প্রয়োগের মাধ্যমে ঘরেই দীর্ঘমেয়াদে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করতে পারবেন কৃষক। এ পদ্ধতিতে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করলে পচেও কম; তা ছাড়া ওজনও মোটামুটি ঠিক থাকে। বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) গবেষকদের এক গবেষণার ফলে এমনটা দেখা গেছে। গবেষকরা বলছেন, এভাবে কৃষকের ঘরেই ৭-৯ মাস পর্যন্ত পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা সম্ভব।
কয়েক বছর ধরে বিনার উদ্যানতত্ত্ব বিভাগ পেঁয়াজ, রসুন, আলু, আম, কলা, পটোল, করলাসহ অন্যান্য পচনশীল ফসলে গামা রশ্মি প্রয়োগের মাধ্যম সংরক্ষণকাল বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন গবেষণা করে সাফল্য পেয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় এবার পেঁয়াজ নিয়ে পরীক্ষাতেও সাফল্য এসেছে।
গবেষকরা বলছেন, রেডিয়েশন প্রয়োগের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা গেলে আমদানিনির্ভরতা কমবে। সেইসঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় রোধ হবে এবং পেঁয়াজের বাজার স্থিতিশীল থাকবে।
গবেষক দলে ছিলেন বিনার মহাপরিচালক ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম, উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. রফিকুল ইসলাম ও ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. নাসরীন আখতার।
গবেষকরা জানান, বিনার উদ্যানতত্ত্ব বিভাগ ২০২০ সাল থেকে পোস্টহারভেস্ট গবেষণাগারে বিভিন্ন ডোজ গামা রশ্মি প্রয়োগ করে বিভিন্ন পরীক্ষণ করেছে এবং বিভিন্ন ফসলের সংরক্ষণের জন্য গামা রেডিয়েশন ডোজ নির্দিষ্ট করেছে। পেঁয়াজের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ১০০ গ্রাম ডোজ গামা রশ্মি প্রয়োগের ফলে পেঁয়াজের গাছ গজানো শতভাগ বন্ধ হয়েছে। এতে পেঁয়াজের ওজন হ্রাস ও পচন কম হচ্ছে। পেঁয়াজের গুণগতমান বজায় রেখে ঘরের তাপমাত্রায় ৭-৮ মাস সংরক্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে। পরীক্ষণটি ভালোভাবে যাচাই করার জন্য ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে বিভিন্ন জেলায় কৃষকের নিজ ঘরে পেঁয়াজের দুটি জাত তাহেরপুরী ও লালতীর কিংয়ে নির্দিষ্ট মাত্রায় গামা রশ্মি প্রয়োগ করা হয় এবং রেডিয়েশন প্রয়োগ ছাড়া পেঁয়াজকে জুলাই ২০২৩ থেকে জানুয়ারি ২০২৪ পর্যন্ত মাচায় সংরক্ষণ করা হয়।
ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. নাসরীন আখতার জানান, গামা রশ্মি প্রয়োগের ফলে পেঁয়াজের দুটি জাতেই গাছ গজানো সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়েছে। পচার হার কম এবং ওজন মোটামুটি ঠিক আছে। অন্যদিকে যেসব পেঁয়াজে রেডিয়েশন প্রয়োগ করা হয়নি, সেখানে শতভাগ গাছ গজিয়েছে; ওজন কমেছে এবং পচন অনেক বেড়েছে।
পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার পেঁয়াজ চাষি আনন্দ সাহা জানান, পেঁয়াজ সংরক্ষণের এ পদ্ধতি নিয়ে তারা খুবই আশাবাদী। এতে কৃষককে লোকসান গুনতে হবে না। তিনি বলেন, এটি দেখে এলাকার পেঁয়াজ চাষিরা অবাক হয়েছেন।
ঈশ্বরদীর চাষি মতিউর রহমান জানান, এভাবে পেঁয়াজ সংরক্ষণের পর তারা রান্নায় ব্যবহার করেছেন। স্বাদ, গন্ধ ও ঝাঁঝের কোনো পরিবর্তন ছিল না।
বিনা উপকেন্দ্র রংপুরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আলী বলেন, চাষিরা এ পদ্ধতিতে পেঁয়াজ সংরক্ষণে খুব আগ্রহী।
বিনার মহাপরিচালক ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম বলেন, কৃষকের কথা মাথায় রেখে বাণিজ্যিকভাবে রেডিয়েশন প্রয়োগের জন্য বিশ্বব্যাংকের অংশীদার প্রকল্পের আওতায় ১১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে বিনা আঞ্চলিক গবেষণা কেন্দ্র, গাজীপুরে গামা সেন্টার স্থাপনের কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে। এ সেন্টারে গামা ইরাডিয়েটর দিয়ে কম খরচে পেঁয়াজ, রসুন, আদা, আলু, আম, কলা, অন্যান্য সবজি ও মসলাসহ পচনশীল উদ্যানতাত্ত্বিক ফসল ও প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য যেমন জ্যাম, জেলি, আচার, সস, জুস ইত্যাদিতে রেডিয়েশন প্রয়োগ করে দীর্ঘমেয়াদে সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, এ দেশে উচ্চ তাপমাত্রা ও উচ্চ আর্দ্রতার কারণে কৃষক পেঁয়াজ নিজ ঘরে ২-৩ মাস সংরক্ষণ করতে পারেন। কিন্তু এ পদ্ধতিতে আরও বেশি সময় রাখা যাবে।
গামা রশ্মি প্রয়োগের মাধ্যমে পেঁয়াজের ওজন হ্রাস, পচন, স্পাউটিং কমিয়ে আনা হলো একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি, যা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।