দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পর উপজেলা নির্বাচনেও ধরাশায়ী বিরোধী দল জাতীয় পার্টি (জাপা)। জনপ্রিয়তা হারানোর কারণে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রার্থীও পাচ্ছে না জাপা। শেষ পর্যন্ত যারা অংশ নিচ্ছেন, তাদের সবাই পরাজিত হচ্ছেন। এ নিয়ে দলের হাইকমান্ডও বিব্রত।
দুই পর্বের অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে জাপার হয়ে লাঙ্গল প্রতীকে ৩২ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। এর মধ্যে একজন বাদে কেউ পাস করতে পারেননি। একমাত্র প্রার্থী বরিশালের মুলাদী উপজেলায় ভাইস চেয়ারম্যান পদে স্থানীয় জাপা নেতা মাকসুদা বেগম পাস করেছেন বলে জানা গেছে।
ষষ্ঠ উপজেলা নির্বাচনে দেশের মোট ৪৯৫ উপজেলার মধ্যে নির্বাচন উপযোগী ৪৮৫টিতে চার ধাপে ভোট হচ্ছে এবার। প্রথম ধাপের ১৩৯ উপজেলায় ভোট হয়েছে গত ৮ মে; ২১ মে ১৫৬ উপজেলায় অনুষ্ঠিত হয়েছে দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচন। এরপর ২৯ মে তৃতীয় ধাপে এবং ৫ জুন চতুর্থ ধাপের ভোট রয়েছে।
আওয়ামী লীগ দলীয় প্রতীকে এবারের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রার্থী দেয়নি। মূলত নির্বাচনে সব দল ও ভোটারদের অংশগ্রহণ বাড়াতেই এই কৌশল নেয় ক্ষমতাসীন দল। কিন্তু বর্জনের ধারাবাহিকতায় নির্বাচনে আসেনি বিএনপি। জাপা দলীয় প্রতীকে প্রার্থী দেওয়ার ঘোষণা দেয়। বিরোধী দল হিসেবে অস্তিত্ব রক্ষায় দলটি দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের ঘোষণা দিলেও শুরুতেই প্রার্থী সংকটের মুখে পড়ে। মনোনয়ন ফরম বিক্রির জন্য বনানীতে পার্টির চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে দপ্তর বিভাগ থেকে বুথও খোলা হয়েছে। সেখানে সুনসান নীরবতা। দিনভর দায়িত্ব পালন করেও প্রার্থীর দেখে মিলছে না।
পার্টি সূত্রে জানা গেছে, অনেকেই কেন্দ্রীয় নেতাদের মুখ রক্ষায় মনোনয়ন সংগ্রহ করেও জমা দেননি। জনপ্রিয়তা আছে এমন প্রার্থীদের উপজেলা নির্বাচনে দলের পক্ষ থেকে খরচ বহনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তাতেও অনেকে সম্মত হননি।
জাপার একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা ও প্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলে নির্বাচন বিমুখতা ও ফল বিপর্যয়ের কারণ জানার চেষ্টা করা হয়েছে। তারা বলছেন, দলীয় কর্মসূচি না থাকা, ক্ষমতাসীনদের মধ্যে দলকে বিলিয়ে দেওয়া, তৃণমূলের নেতাকর্মীদের প্রাধান্য না দেওয়া, জনপ্রিয়তা ও সমর্থক কমতে থাকার কারণেই জাপার সাংগঠনিক শক্তি কমছে। সেইসঙ্গে মাঠপর্যায়ে জনপ্রিয়তাসহ কর্মী-সমর্থক হারিয়েছে দলটি।
বেশিরভাগ উপজেলায় অস্তিত্ব সংকটে জাপা। এসব কারণে নিশ্চিত ফল বিপর্যয় জেনে কেউ নির্বাচনে পথে হাঁটতে চান না।
সর্বশেষ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ২৬ আসনে সমঝোতা করলেও মাত্র ১১টিতে জয় পেয়েছে দলটি। এর বাইরে দুই শতাধিক আসনে জাপা প্রার্থীদের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। সংসদ নির্বাচনের ফল বিপর্যয়কে সামনে উদাহরণ হিসেবে ধরে দলের অনেকেই স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অনাগ্রহ প্রকাশ করছেন। দলের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের পরিস্থিতিও একই রকম।
জাপার দপ্তর সম্পাদক এম রাজ্জাক খান কালবেলাকে বলেন, দুই পর্বের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলের ফলাফল উল্লেখ করার মতো কিছু নেই। তিনি বলেন, দুই পর্বে ৩২ জন অংশ নেন। এর মধ্যে বরিশালের মুলাদীতে একজন নারী ভাইস চেয়ারম্যান ছাড়া কেউ পাস করতে পারেননি। বাকি দুদফার নির্বাচনে সব প্রার্থী এখনো ঠিক হয়নি বলেও জানান তিনি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ১৯৯০ সালে এইচ এম এরশাদের সরকারের পতনের পরও তার দল জাপা বেশিরভাগ সময় ক্ষমতাসীনদের সঙ্গেই ছিল। এর পর ক্রমশ দলটি এতটাই দুর্বল হয়েছে যে, এককভাবে নির্বাচন করার সামর্থ্যও এখন হারিয়েছে। ৩০০ আসনে শক্তিশালী প্রার্থীও দিতে পারে না দলটি। তারা বলছেন, জাপা শুধু দুর্বলই হয়নি, পথও হারিয়েছে। সরকার ঘনিষ্ঠ হয়ে টিকে থাকার চেষ্টা দলটিকে জনবিচ্ছিন্ন করেছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত যৌথ সভায় দলটির তৃণমূল নেতারাও একই বক্তব্য তুলে ধরেছেন।
১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি জাপার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর ক্ষমতাচ্যুত হন এরশাদ। এরপর জাপা আর ক্ষমতায় আসতে পারেনি। রাজনৈতিক নানা বৈরী পরিস্থিতির মুখে দল পরিচালনা করেছেন পার্টির প্রতিষ্ঠাতা এরশাদ। নিজেও জেল খেটেছেন। তবে টানা তিন মেয়াদে বিরোধী দলের আসনে আছে জাপা। বলা হয়, ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে সুসময় পার করছে জাপা।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের নির্দ্বিধায় স্বীকার করেন, ১৯৯০ সালের পর জাতীয় পার্টি ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়েছে। তার দলে সরকারি দলের এজেন্ট ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে বলেও মনে করেন তিনি।
এরশাদ ক্ষমতা গ্রহণের পর ১৯৮৬ সালের ৭ মে অনুষ্ঠিত হয় তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ওই নির্বাচনে ১৫৩টি আসনে জয়লাভ করে জাপা। এর দুই বছরের মধ্যে ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ প্রায় সব রাজনৈতিক দলের বর্জন করা ওই নির্বাচনে জাপা ২৫১টি আসনে জেতে। ওই সংসদের মেয়াদ পেরোনোর আগেই নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এরশাদের পতন ঘটে। এরপর ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে জাপা ৩৫টি আসন পায়। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পায় ৩২টি। ২০০১ সালের নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে জোট করে জাপা পায় মাত্র ১৪টি আসন। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনে ২৭টি; ২০১৪ সালের নির্বাচন বিএনপি বর্জন করলেও জাতীয় পার্টি পায় ৩৪টি আসন। এরপর ২০১৮ সালের নির্বাচনে সেটি আরও কমে দাঁড়ায় ২২-এ। সর্বশেষ গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ২৬টি আসনে সমঝোতা করেও ১১টির বেশি জিততে পারেনি দলটি।
পার্টির শীর্ষ নেতারা জানিয়েছেন, এর আগে উপজেলাসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলের প্রতিনিধিত্ব ছিল ৪০ জনের মতো। এবার তা কমে নামেমাত্র গিয়ে ঠেকবে।
জানতে চাইলে জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু কালবেলাকে বলেন, নির্বাচনে জয় পরাজয় থাকবে এটি স্বাভাবিক। তবুও আমরা চেষ্টা করছি বেছে বেছে প্রার্থী দেওয়ার। আশা করি আগামী দুই পর্বের উপজেলা নির্বাচনে দলের বিজয়ী প্রার্থীর সংখ্যা বাড়বে।