নৌপথ ১০ হাজার কিলোমিটারে বৃদ্ধি, নদীর দূষণ কমানো থেকে শুরু করে নিরাপদ নৌপথ গড়ে তোলাসহ বিভিন্ন বিষয়ে ১৫ বছর আগে পরিকল্পনা নেওয়া হলেও এখনো তা বাস্তবায়ন হয়নি। এই সময়ে দুই হাজার কিলোমিটার নৌপথ বেড়েছে। এতে নৌপথ হয়েছে ছয় হাজার কিলোমিটার। তবে বন্ধ করা যায়নি অবৈধ নৌযান। এক লাখের বেশি অবৈধ নৌযান দাবড়ে বেড়াচ্ছে নদীপথে। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে চলছে বাল্কহেড। যাত্রী ও পণ্যবাহী নৌযান দুর্ঘটনায় বছরে প্রাণ যাচ্ছে ছয়শরও বেশি মানুষের। গত ১০ বছরে নৌপথে মৃত্যু হয়েছে ছয় হাজারের বেশি মানুষের। এদিকে নদীতে অবৈধ দখল উচ্ছেদ অভিযান চলমান থাকলেও কার্যত দখলদার বেড়েছে। নদী রক্ষা কমিশনের ২০১৯ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, নদী দখলদার ৫৭ হাজার ৩৯০। সর্বশেষ ২০২২ সালের হিসাবে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৩ হাজার ২৪৯।
এমন প্রেক্ষাপটে আজ (মঙ্গলবার) থেকে দেশে শুরু হচ্ছে নৌ নিরাপত্তা সপ্তাহ। লন্ডনে অবস্থিত মেরিটাইম অর্গানাইজেশনের (আইএমও) পরামর্শ অনুযায়ী প্রতি বছর দিবসটির আয়োজন করা হয়। এবারের প্রতিপাদ্য হলো—‘দূষণমুক্ত নদী ও নিরাপদ নৌযান, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে রাখবে অবদান’। আজ বাংলাদেশ শিশু একাডেমিতে নৌ নিরাপত্তা সপ্তাহ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী।
দূষণমুক্ত নদী ও নিরাপদ নৌযান চলাচল নিশ্চিতে মন্ত্রণালয় কতটুকু সফল জানতে চাইলে নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, আমরা কয়েক বছর ধরে দূষণমুক্ত নদী ও নিরাপদ নৌযানের প্রতিপাদ্য নিয়ে নৌ নিরাপত্তা সপ্তাহ পালন করছি। লক্ষ্য পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আমরা প্রতিপাদ্য থেকে সরছি না। লক্ষ্যে পৌঁছানের পর পরবর্তী প্রতিপাদ্য নিয়ে মন্ত্রণালয় এগিয়ে যাবে। নৌপথ দূষণমুক্ত করা ও নিরাপদ নৌপথ গড়ে তুলতে না পারলে ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট
বাংলাদেশের লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে না।
জানা গেছে, ১৯৬০ সালে দেশে নদীপথের দৈর্ঘ্য ছিল ২৪ হাজার কিলোমিটারের বেশি। এর মধ্যে নৌ পরিবহনযোগ্য নৌপথের দৈর্ঘ্য ছিল পাঁচ হাজার ৯৬৮ কিলোমিটার। শুষ্ক মৌসুমে তা কমে দাঁড়ায় তিন হাজার ৮৬৫ কিলোমিটারে। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর নৌপথ ১০ হাজার কিলোমিটারে উন্নীত করার উদ্যোগ নেয়।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির গবেষণা বলছে, ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন সংস্থা (বিআইডব্লিউটিএ)। শুষ্ক মৌসুমে নৌপথের আয়তন ছিল প্রায় চার হাজার কিলোমিটার। ১৫ বছরে তা দুই হাজার কিলোমিটার বেড়ে ছয় হাজারে উন্নীত হয়েছে।
নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে বলেন, নৌ যোগাযোগ খাতের উন্নয়ন ও আধুনিকায়নে সরকার নানামুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেই এ বিষয়ে আন্তরিক। কিন্তু গত দেড় দশকেও কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হয়নি। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, অধিকাংশ প্রকল্পই বাস্তবসম্মত নয়। এ ছাড়া প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের অনেকেরই দক্ষতা ও দায়িত্বশীলতার ঘাটতি দেখা যায়। অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতিও রয়েছে।
দূষণের কবলে নৌপথ: দেশের প্রায় সবগুলো নদ-নদীতে শিল্পবর্জ্য ও মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) উদ্যোগে দেশের ৫৬টি প্রধান নদ-নদীর ওপর সম্প্রতি করা এক গবেষণার তথ্য বলছে, এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দূষিত নদী হলোÑ গাজীপুরের লবণদহ, নরসিংদীর হাঁড়িধোয়া ও হবিগঞ্জের সুতাং। তবে ৫৬টি নদ-নদীতেই সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি দূষণের অস্তিত্ব মিলেছে।
নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটি বলছে, নৌপথের কোনো না কোনো অংশ দূষণের শিকার। দখল, বর্জ্য ফেলা, পানি প্রবাহ না থাকা,Ñমূলত এই তিন কারণে নদী বেশি মাত্রায় দূষণ হচ্ছে। ১৫ বছরে দেশের নদ-নদী খননে ডজনখানেক বড় প্রকল্প নেওয়া হলেও এর বেশিরভাগই বাস্তবায়িত হয়নি। উত্তরের জনপথে চার নদী নিয়ে ১৮ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের চার ভাগের একভাগ কাজ শেষ হয়েছে। তেমনি পুরোনো ব্রহ্মপুত্র নিয়ে করা প্রকল্পটিরও বেহাল অবস্থা। নানা কারণে পার্বত্য এলাকায় নদীদূষণ বাড়ছে। তেমনি বৃহত্তর সিলেটের চিত্রও একই রকম।
নৌ দুর্ঘটনা: দেশে নিবন্ধিত নৌযান ১৫ হাজার। এর মধ্যে লঞ্চ, ট্রলারসহ যাত্রীবাহী নৌযানের সংখ্যা প্রায় চার হাজার। বাকিগুলো পণ্যবাহী নৌযান। জাতীয় কমিটি বলছে, অবৈধ এক লাখের বেশি নৌযান চলাচল করছে। যদিও ২০২৩ সালে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের ৮৫ হাজার অবৈধ নৌযানের কথা বলা হয়েছিল। নিয়ম অনুযায়ী, নৌযানগুলোর নিবন্ধন নেওয়ার পাশাপাশি প্রতি বছর ফিটনেস সনদ হালনাগাদ করতে হয়। এ সনদ দিতে নৌযানের মাস্টার-ড্রাইভারের সনদ, জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম ও অন্য আনুষঙ্গিক বিষয়সহ ৫১টি বিষয় দেখেন নৌপরিবহন অধিদপ্তরের সার্ভেয়াররা, যা যথাযথভাবে না দেখার অভিযোগ বিস্তর।
লঞ্চ মালিক সমিতির সহসভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু কালবেলাকে বলেন, সবার সম্মিলিত চেষ্টায় নৌপথের নিরাপত্তা ও দূষণমুক্ত নদী গড়ে তুলতে হবে। কারও একার পক্ষে এ কাজে সফল হওয়া কঠিন।