বৃহস্পতিবার, ০১ মে ২০২৫, ১৮ বৈশাখ ১৪৩২
মুফতি আরিফ খান সাদ
প্রকাশ : ০৩ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:৩১ এএম
আপডেট : ০৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১০:২৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

কোরআনের বর্ণনায় সফল ও ব্যর্থ মানুষ

কোরআনের বর্ণনায় সফল ও ব্যর্থ মানুষ

আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন সুরা ও আয়াতে মানুষকে উপদেশ দিয়েছেন। জীবনে চলার পথে বাস্তব কিছু উপমার ভিত্তিতে জানিয়েছেন পৃথিবীতে মানুষের কী করণীয়, কী বর্জনীয়; কোন শ্রেণির মানুষ সফল এবং কোন শ্রেণির মানুষ ব্যর্থ। তেমনি একটি সুরা হলো—সুরা আসর। এ সুরায় আল্লাহ জানিয়েছেন কারা সফল এবং কারা ব্যর্থ ও ক্ষতিগ্রস্ত। সুরা আসরের শিক্ষা ও মাহাত্ম্য নিয়ে সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে আলোচনা-পর্যালোচনা হতো। হাদিসে এসেছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে হাফস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সাহাবিদের মধ্যে এমন একটি চর্চা ছিল যে, দুজন সাহাবি কোথাও একত্র হলে একে অন্যকে সুরা আসর না শুনিয়ে পৃথক হতেন না। (বায়হাকি, শুয়াবুল ইমান : ২৬৪৮)। ইমাম শাফেই (রহ.) বলেন, ‘যদি মানুষ এ সুরাটি নিয়ে গবেষণা করত, তাহলে এটাই তাদের জন্য যথেষ্ট হতো।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির)। মাত্র তিন আয়াতের ছোট্ট এ সুরায় আল্লাহতায়ালা বলেন—‘১ সময়ের শপথ! ২. নিশ্চয়ই সব মানুষ ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। ৩. তবে তারা ব্যতীত; যারা ইমান এনেছে, সৎকাজ করেছে এবং পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দিয়েছে ও পরস্পরকে ধৈর্যের উপদেশ দিয়েছে (সুরা আসর: আয়াত ১-৩)।’

প্রথম আয়াত: সময়ের কসম

‘সময়ের শপথ!’ আল্লাহতায়ালা এ সুরায় সময়ের শপথ করেছেন এজন্য যে, বান্দা ভালো-মন্দ যে কাজই করুক না কেন, তা অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ—এ তিনকালের মধ্যেই তাকে করতে হয়। এর বাইরে গিয়ে কিছুই করা যায় না। অতএব বান্দাকে সবসময় আল্লাহর দৃষ্টির সীমানার ভেতরেই থাকতে হয়। কেননা বান্দার হিসাবে কাল তিনটি হলেও আল্লাহর কাছে সবই বর্তমান। বান্দার দিক থেকেও সময়, যুগ ও কাল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মানুষের জীবন মূলত সময়েরই সমষ্টি। একটু একটু করে সময় অতিবাহিত হচ্ছে মানে জীবনের একটু একটু অংশ গলিত বরফের মতো কমে যাচ্ছে। একজন বরফ বিক্রেতা যত বড় বরফের টুকরো নিয়েই বসুক না কেন, সেটি যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বিক্রি করতে না পারেন, তাহলে গলে নিঃশেষ হয়ে যাবে। দিন শেষে অবশিষ্ট কিছুই থাকবে না। তেমনি মানুষ তার জীবনের সময়গুলো কাজে না লাগালেও সময় ঠিকই বয়ে যাবে। আর নির্ধারিত সময় চলে গেলে বান্দার কোনো কিছুই তখন কাজে আসবে না। এমনকি আল্লাহর দরবারেও তার আমল কবুল হবে না। খ্যাতনামা মুফাসসির ইমাম রাজি (৫৪৪-৬০৬ হি.) ‘আসর’-এর সঠিক তাৎপর্য কী হবে, সে বিষয়ে তার পূর্বসূরি এক মনীষীর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, তিনি এটা নিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন ছিলেন। এমতাবস্থায় একজন বরফ বিক্রেতার আওয়াজ তার কানে এলো। সে চিৎকার দিয়ে ক্রেতাদের উদ্দেশে বলছিল, ‘তোমরা রহম করো ওই ব্যক্তির প্রতি, যার পুঁজি প্রতিমুহূর্তে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।’ এ কথা শুনেই তিনি বলে উঠলেন, ‘এটাই তো সুরা আসরের তাৎপর্য। যার বয়স চলে যাচ্ছে। অথচ কোনো সৎকর্ম করছে না। সে অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত।’ (তাফসিরে রাজি)

আসলে ‘কাল’ প্রতি সেকেন্ডে সময়ের গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে। অতএব প্রত্যেক মানুষকে তার সংক্ষিপ্ত আয়ুষ্কালের মধ্যেই ক্ষতির হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করতে হবে। কেননা মানুষ প্রতি সেকেন্ডে ১ লাখ ৮৬ হাজার মাইল (৩ লাখ কিমি) গতিবেগে তার মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছে। বরফ গলার মতো প্রতি সেকেন্ডে মানুষের আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে কালের স্মৃতিপটে তার প্রতিটি কথা ও কর্ম লিপিবদ্ধ হচ্ছে। এ কারণেই আল্লাহ কালের শপথ করেছেন। তাই সময়কে কাজে লাগাতে হবে। কোনোভাবেই কালক্ষেপণ করা যাবে না।

দ্বিতীয় আয়াত: প্রতিটি মানুষ ক্ষতির মুখে

‘নিশ্চয়ই সব মানুষ ক্ষতির ভেতর রয়েছে’। আরেকটি আয়াতে আল্লাহতায়ালা এমনই বলেছেন, ‘অতঃপর তারা তাদের কৃতকর্মের আজাব আস্বাদন করল। আসলে ক্ষতিই ছিল তাদের কর্মের পরিণতি।’ (সুরা তালাক: ৯)। সুরা আসরের এ আয়াতে ‘নিশ্চয়ই সব মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত’ না বলে ‘নিশ্চয়ই সব মানুষ ক্ষতির ভেতর রয়েছে’ বলার মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে—মানুষ মজ্জাগতভাবে ক্ষতিকর প্রবণতার ভেতরে লিপ্ত। ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় মানুষ হয়তো নিজের বা অন্যের ক্ষতি করেই চলেছে। সমাজের নানা অপরাধ, খুন, লুটপাট, খাদ্যে ভেজাল, দুর্নীতি, মিথ্যা, চুরি-ডাকাতি, ধর্ষণ, পরকীয়া থেকে শুরু করে ইতিহাসের বিভিন্ন যুদ্ধবিধ্বস্ত জাতি ও সভ্যতার ইতিহাস দেখলেই বোঝা যায়। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘হে লোকসকল! জাহান্নাম থেকে বাঁচানোর জন্য আমি তোমাদের কোমর ধরে আকর্ষণ করি। তোমরা জাহান্নাম থেকে আমার দিকে ফিরে এসো! তোমরা জাহান্নাম থেকে আমার দিকে ফিরে এসো! কিন্তু তোমরা আমাকে পরাস্ত করে জাহান্নামে ঢুকে পড়ছ!’ (বোখারি: ৬৪৮৩; মুসলিম: ২২৮৪)। এই হাদিস থেকেও বুঝে আসে মানুষ ক্ষতিকর প্রবণতায় রয়েছে। তবে সেই ক্ষতি থেকে বাঁচার পথও পরের আয়াতে বলে দিয়েছেন মহান আল্লাহ।

তৃতীয় আয়াত: সফল মানুষের পরিচয়

‘তবে তারা ব্যতীত; যারা ইমান এনেছে, সৎকাজ করেছে এবং পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দিয়েছে ও পরস্পরকে ধৈর্যের উপদেশ দিয়েছে’—এ আয়াতে আল্লাহতায়ালা চারটি গুণের কথা উল্লেখ করেছেন—যার মাধ্যমে মানুষ সফলতা ও মুক্তি অর্জন করতে পারে। গুণগুলো হলো—১. পরিপূর্ণভাবে ইমান আনা। ২. নিজে সৎকাজ করা। ৩. অন্যকে সত্য ও ভালো কাজের উপদেশ দেওয়া এবং ৪. অন্যকে বিপদে ধৈর্যের উপদেশ দেয়।

কোনো বান্দা এ গুণাবলিগুলো নিজের মধ্যে ধারণ করতে পারলে ক্ষতি থেকে বাঁচতে সক্ষম হবে এবং চূড়ান্ত সাফল্যের পথে অগ্রসর হতে পারবে। প্রথম দুটি গুণের ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা একটি আয়াতে সুসংবাদ দিয়েছেন—‘যারা ইমান আনে এবং সৎ ও ভালো কাজ করে, তাদের কৃতকর্মের পুরস্কারস্বরূপ তাদের আপ্যায়নের জন্য জান্নাত হবে তাদের বাসস্থান।’ (সুরা হামিম সাজদা: ১৯)। তৃতীয় গুণের ব্যাপারে নির্দেশ দিয়ে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তুমি বলো সত্য তোমাদের রবের পক্ষ থেকে। সুতরাং যার ইচ্ছা ইমান আনুক আর যার ইচ্ছা কুফরি করুক। আমি সীমালঙ্ঘনকারীদের জন্য জাহান্নাম প্রস্তুত করে রেখেছি।’ (সুরা কাহাফ: ২৯)। আর চতুর্থ গুণ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘ধৈর্যধারণকারীদের অগণিত পুরস্কার দান করা হবে।’ (সুরা জুমার: ১০)। আল্লাহ আরও বলেন, ‘ধৈর্য ও সবরের পুরস্কার স্বরূপ তিনি তাদের জান্নাত ও রেশমি পোশাক দান করবেন। তারা সেখানে সুসজ্জিত আসনে হেলান দিয়ে বসবে। সেখানে তারা অতি গরম বা অতি শীত কোনোটাই দেখবে না।’ (সুরা দাহর: ১২-১৩)।

আল্লাহতায়ালা আমাদের এই সুরার প্রকৃত মর্ম ও শিক্ষা বোঝার ও তদানুযায়ী আমল করার তাওফিক দান করুন।

লেখক: মুহাদ্দিস ও ইসলামী চিন্তাবিদ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

প্রকৌশলীদের উন্নয়ন ও সংস্কার নিয়ে আইইবি’র মতবিনিময় সভা 

সৈয়দপুরে শাটল বাস সার্ভিস চালু করল বিমান

প্রকৌশলীদের অধিকার আদায়ে সারাদেশে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

সার্জেন্ট হেলালের সাহসিকতায় ২ ছিনতাইকারী আটক

শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের ‘মহান মে দিবস’ আজ

নোবিপ্রবির পুকুরে ছাত্র-ছাত্রীদের গোসলের ছবি ভাইরাল, প্রশাসনের সতর্কতা

রাজধানী থেকে পুরনো যানবাহন সরাতে অ্যাকশনে নামছে বিআরটিএ

কালবেলায় সংবাদ প্রকাশের পর ইউএনওকে বদলি

ববি প্রশাসনকে ‘মৃত’ ঘোষণা করে গায়েবানা জানাজা

স্কুলের ১৮টি গাছ কাটলেন প্রধান শিক্ষক

১০

শাহ আমানত বিমানবন্দরের রানওয়েতে কুকুর, ব্যবস্থা নিতে মেয়রকে চিঠি

১১

আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্বে কুপিয়ে হত্যা

১২

বাবরি মসজিদ বানাবেন পাকিস্তানি সেনারা : পাকিস্তানের সিনেটর

১৩

কাশ্মীর হামলার পর চাপে ভারতের মুসলিমরা, বেড়েছে দমনপীড়ন

১৪

ছাত্রদের ক্ষমতায় এনে দেশের ক্ষতি করা হয়েছে : সোহেল

১৫

সন্ধ্যা নদীতে বাঁধ নির্মাণের দাবি

১৬

মে মাসে হতে পারে ২টি ঘূর্ণিঝড়

১৭

শ্রমিক সমাবেশে নির্দেশনামূলক বক্তব্য দেবেন তারেক রহমান

১৮

ভয়াবহ পরিস্থিতিতে ‘জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা ইসরায়েলে

১৯

গ্রাহকদের জন্য বাড়তি সুবিধা আনল বাংলালিংক

২০
X