আমি যেহেতু একজন স্পেশাল নিড এডুকেটর, তাই বুঝতে পারছিলাম খাবার দিয়ে অনেক কিছু সমাধান সম্ভব। এরপরই Dining with Shahajade (ডাইনিং উইথ শাহজাদী) নামের ছোট্ট একটি উদ্যোগ নিয়ে পথচলা শুরু করি, যেখানে শুধু প্রিজারভেটিভ ছাড়া স্বাস্থ্যকর খাবার বিক্রির কথা ভাবি। যখন ব্যবসা শুরু করি, তখন হাতে ছিল মাত্র ৪০ হাজার টাকা আর অসংখ্য স্বপ্ন। তবে শুরুটা সহজ ছিল না। কখনো শুনতে হয়েছে এত বড় স্বপ্ন দেখছ কেন? তোমার পক্ষে একা এতকিছু করা সম্ভব নয়! তবে উদ্যোক্তা হওয়ার পথে সবচেয়ে বড় বাধাগুলোর একটি হলো সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি—নারী মানেই যেন সংসারের দায়িত্ব পালন করবে আর না হয় লেখাপড়া করে ৯-৫টা চাকরি করবে। ব্যবসা করা তার জন্য নয়! কিন্তু নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস হারাইনি। আমি মনে করি যে কোনো কিছু করার জন্য বিশ্বাসটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এভাবে করেই নিজের উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প জানালেন শাহজাদী হোসনে জাহান
বাংলাদেশে সরাসরি কিংবা অনলাইন—দুই ধরনের ব্যবসাতেই নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা অনেক বাড়লেও নারী হিসেবে ব্যবসা করা কিংবা ব্যবসা সম্প্রসারণ করার ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত বাধাও বাড়ছে। কী ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি নারীদের হতে হয়? এ প্রসঙ্গে শাহজাদী বলেন, নারী উদ্যোক্তাদের জন্য পথচলা এখনো সহজ হয়ে ওঠেনি। আমাদের একসঙ্গে বহু দিক সামলাতে হয়—ব্যবসার পাশাপাশি পারিবারিক, সামাজিক ও ব্যক্তিগত দায়িত্বও থাকে। অনেক সময় বিনিয়োগ পাওয়া কঠিন হয়ে যায়, কারণ বিনিয়োগকারীরা মনে করেন একজন নারী হয়তো দীর্ঘমেয়াদি ব্যবসা ধরে রাখতে পারবে না; তার ওপর যদি নারী অবিবাহিত হয় তাহলে তো আরও কঠিন। অনেকেই ব্যবসাকে শখের বিষয় বলে ধরে নেয়, সিরিয়াস কিছু নয়। কর্মীদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত সাপোর্ট নাও পাওয়া যেতে পারে, কারণ একজন নারী বস হলে অনেকেই সেটিকে সহজভাবে নেয় না। এ ছাড়া নিরাপত্তার বিষয়ও বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়, বিশেষত যদি ব্যবসার জন্য বাইরে বের হতে হয়।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের ব্যবসায়ে নারীদের আগ্রহ বেশি। কৃষি ও মৎস্য খাত, খাদ্য প্রক্রিয়াজাত, পর্যটন, ফ্যাশন ও সৌন্দর্য পণ্য, স্বাস্থ্যবিষয়ক পণ্য এবং অনলাইন ব্যবসায়ে নারী ব্যবসা করছে বেশি। গার্মেন্টস ও অ্যাকসেসরিজ, বিউটি পার্লার, টেইলারিং, রিটেইল শপ, আইটি, ইলেকট্রনিকস, সফটওয়্যার, পাটজাত পণ্য ও হ্যান্ডিক্র্যাফটস খাতে নারী উদ্যোক্তা বাড়ছে। ব্যবসার ক্ষেত্রে অনেক বড় ভূমিকা পালন করছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো। শাহজাদী বলেন, আমার ব্যবসার মূল শক্তি ছিল সোশ্যাল মিডিয়া। যদি এটি না থাকত, তবে এতদূর আসা সম্ভব হতো না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন নারীদের জন্য একটি শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম, যেখানে তারা কম খরচে ব্র্যান্ড গড়ে তুলতে পারেন, তাদের পণ্যকে প্রচার করতে পারেন এবং গ্রাহকদের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করতে পারেন। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে উদ্যোক্তারা কম খরচে বিজ্ঞাপন দিতে পারেন, লাইভে এসে সরাসরি গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন এবং খুব সহজেই তাদের ব্র্যান্ড পরিচিত করতে পারেন। তবে অনলাইন ছাড়াও অফলাইনে যাওয়ার পরিকল্পনা থাকতে হয়। আমাদের সমাজে নারী ও পুরুষ উদ্যোক্তাদের মধ্যে এখনো স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। যেমন—
অর্থনৈতিক বৈষম্য: পুরুষ উদ্যোক্তারা তুলনামূলকভাবে সহজে বিনিয়োগ পান, কিন্তু নারীদের ক্ষেত্রে বিনিয়োগ পেতে দ্বিধা থাকে।
নেটওয়ার্কিং সুযোগ: ব্যবসার ক্ষেত্রে পরিচিতি ও যোগাযোগ খুব গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু নারী উদ্যোক্তাদের জন্য এ সুযোগ সীমিত থাকে।
সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি: একজন পুরুষ যদি ব্যবসা শুরু করে, তাহলে সবাই তাকে উৎসাহ দেন। কিন্তু একজন নারী উদ্যোক্তা হলে তাকে প্রমাণ করতে হয় যে, তিনি শুধুই শখের বসে কাজ করছেন না, বরং এটি তার ভবিষ্যৎ।
নারীদের স্বাবলম্বী হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জানিয়ে এই উদ্যোক্তা বলেন, আমার কাছে এটা শুধু গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং অপরিহার্য। একজন নারী যদি আর্থিকভাবে স্বাধীন না হন, তাহলে তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও সীমিত হয়ে যায়। নারীদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা তাদের সম্মান, আত্মবিশ্বাস এবং নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা এনে দেয়।
নারীদের উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশের জন্য কী কী করণীয়—এ প্রসঙ্গে শাহজাদী হোসনে বলেন, উদ্যোক্তা হওয়া ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। তবে শুধু যে ইচ্ছা থাকলেই হবে তাও নয়; ধৈর্য, পরিশ্রম ও কৌশলও প্রয়োজন। কারণ উদ্যোক্তা হতে হলে বিভিন্ন ধরনের কাজ জানতে হয়, সেইসঙ্গে এসব কাজ সামলে নেওয়ার মানসিকতাও থাকতে হবে। উদ্যোক্তা হতে হলে ব্যর্থতার জন্যও প্রস্তুত থাকতে হয়। প্রতিটি ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হয় এবং ধাপে ধাপে নিজের পথ তৈরি করতে হয়।
নিজের দক্ষতা ও জ্ঞান বাড়ানো: শুধু ব্যবসা শুরু করলেই হবে না, বরং ব্যবসার নানান দিক সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে হবে। কর্মচারীকে কাজে লাগানোর জন্য নিজে রুট লেভেলে কাজ করতে হয়। তবেই বলা যায় ‘বস ইস অলওয়েজ রাইট’।
টাকা ও বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা: আয় ও ব্যয়ের হিসাব রাখতে হবে এবং বিনিয়োগের সঠিক ব্যবহার করতে হবে। বেশিরভাগ সময় উদ্যোক্তারা হিসাব না বুঝেই বলে ফেলেন আমি লাখপতি। এটা বলার জন্য আসলে হিসাব জানা খুব জরুরি।
নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা: ব্যবসায়িক যোগাযোগ তৈরি করা খুব জরুরি, যা দীর্ঘমেয়াদে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। তবে নেটওয়ার্ক তৈরি করাও সময়সাপেক্ষ একটা বিষয়। ধীরে ধীরে তা তৈরি করতে হয়।
নেতৃত্বের দক্ষতা: নিজের ব্যবসায় নিজেকে নেতা হিসেবে তৈরি করতে ও কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রাখতে হয়। যে কোনো ভয়ংকর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সাহস থাকতে হয়।
ধৈর্য ও আত্মবিশ্বাস: ব্যবসায় চ্যালেঞ্জ আসবেই, তবে হাল না ছাড়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
সবশেষে বলতে চাই, আমি আজ যেখানে দাঁড়িয়ে আছি তা সহজ ছিল না। নারীরা যদি আত্মবিশ্বাসী হন, তাদের স্বপ্নের প্রতি দায়বদ্ধ থাকেন এবং পরিশ্রম করতে প্রস্তুত থাকেন, তবে তারা অবশ্যই সফল উদ্যোক্তা হতে পারেন। নারী উদ্যোক্তারা শুধু নিজেরাই স্বাবলম্বী হন না, তারা আরও নারীদের জন্য পথ খুলে দেন। একটা মেয়ে তার শখের কিছু কিনুক তার নিজের ইচ্ছেমতো। নারী নিজের স্বপ্ন পূরণ করুন এবং প্রমাণ করুন—নারী মানেই সীমাবদ্ধতা নয়, বরং শক্তি ও সম্ভাবনার প্রতীক!
মন্তব্য করুন