বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত বছরের ১৯ জুন নারায়ণগঞ্জের জালকুড়ি এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী শাহ জামাল ভূঁইয়া ওরফে জামাল। এক বছর পর তার দেড় বছরের ছেলে ইয়াসিন বাবা ডাক শিখেছে। তবে বাবাকে আর কাছে পায় না সে। কথাগুলো বলতে বলতে ওড়না দিয়ে চোখ মুছছিলেন জামালের স্ত্রী মানসুরা আক্তার।
জামালের গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীর রাঙাবালী উপজেলার বড়বাইশদিয়া ইউনিয়নে। ব্যবসায়িক কারণে পরিবার নিয়ে তিনি নারায়ণগঞ্জের জালকুড়ি স্ট্যান্ড সংলগ্ন এলাকায় থাকতেন। গত রোববার সকালে সেখানেই কথা হয় জামালের স্ত্রী মানসুরার সঙ্গে।
পারিবারিকভাবে প্রায় আড়াই বছর আগে তাদের বিয়ে হয় জানিয়ে মানসুরা বলেন, ‘বিয়ের প্রায় এক বছরের মধ্যে আমাদের ছেলে সন্তান হয়। ফুটফুটে ইয়াসিনের জন্মের পর থেকে ওর বাবা ভিডিও কলে ছেলেকে দেখতে চাইতো। দোকানে গেলেও অনেকবার ফোন করে ছেলেকে দেখতে চাইতো। আমার স্বামী মারা যাওয়ার ঘণ্টাখানেক আগেও ভিডিও কল করে ছেলেকে দেখতে চেয়েছিল। সর্বশেষ দোকানে বসে আমার সঙ্গে কথা বলার সময়ে তিনি গুলিবিদ্ধ হন।’
আফসোস করে তিনি বলেন, ‘স্বামী মারা যাওয়ার সময় ছেলের বয়স ছিল ছয় মাস। ওই সময় ছেলের মুখে কথা ফোটেনি। এখন ছেলের বয়স দেড় বছর। সে বাবা ডাক শিখেছে; কিন্তু কীভাবে বুঝাব তার বাবা আর নেই। অনেক সময় ওর চাচাকে বাবা বলে ডাকে। সরকারি সহায়তা পেয়েছি; কিন্তু আমার ছেলের বাবার অভাব কীভাবে পূরণ করবো।’
মানসুরা আরও বলেন, ‘স্বামীর সঙ্গে আমার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। সে কখনো আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেনি। তবে খুব অল্প সময় তাকে পেয়েছি। এখনো তার নানা স্মৃতি মনে পড়ে। ছেলেকে মাদ্রাসায় পড়ানোর স্বপ্ন ছিল আমার স্বামীর। কিন্তু তিনি এখন আর আমাদের মাঝে নেই।’
জামালের মা মেহেরজান বিবি বলেন, ‘আমার ছেলেকে ওরা কেন মারলো। ও কী দোষ করেছে। আমার ছেলে তো কোনো দলের রাজনীতি করতো না। দোকানে ব্যবসা করার সময় তাকে গুলি করে মেরেছে। এখন দুই ছেলে ও ছেলের বউসহ তাদের সন্তানদের নিয়ে বেঁচে আছি। বড় ও মেজ ছেলে সংসারের খরচ দিচ্ছে। এতে করে আর্থিক কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তবে ছেলের অনুপস্থিতি কী দিয়ে পূরণ করবো।’
জামালের বড় ভাই আলমাস ভূঁইয়া বলেন, ‘প্রায় ১২ বছর আগে জীবিকার সন্ধানে আমি নারায়ণঞ্জে এসে মুরগির ব্যবসা শুরু করি। পরে ব্যবসার পরিধি বাড়িয়ে সবজির ব্যবসাও শুরু করি। মুরগি ও সবজির দুটি দোকান দেখাশোনার মূল দায়িত্বে আমি ছিলাম। আর মেজ ভাই ইমরান ও ছোট ভাই জামাল বছরের কিছু মাস আমার ব্যবসায় সহযোগিতা করতো, আর কিছু মাস পটুয়াখালী গ্রামের বাড়ির কৃষি কাজ করতো। এতে করে নারায়ণগঞ্জের ব্যবসা ও গ্রামের বাড়ির কৃষি পণ্য উৎপাদন করে বেশ ভালো আয় হতো। আমরা তিন ভাই যৌথ পরিবারে বসবাস করি। এখন ছোট ভাই জামাল মারা যাওয়ার পর গ্রামের বাড়ির কৃষি কাজ একেবারে বন্ধ রাখা হয়েছে। পুরো বাড়ি তালা আটকে রাখা হয়েছে। আমার পুরো পরিবারের উন্নয়নের চাকা স্থবির হয়ে গেছে। আমি সব সময় চেয়েছি পুরো পরিবারকে নিয়ে ভালো থাকতে। কিন্তু এর মধ্যে ছোট ভাই চলে গেল।’
তিনি আরও বলেন, ‘গত ১৯ জুলাই শুক্রবার বিকেল ৫টা ৪১ মিনিটে জামাল গুলিবিদ্ধ হয়। পরে তাকে উদ্ধার করে স্থানীয় একটি ক্লিনিকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাই। পথে আমার ভাই জামাল পানি চেয়েছিল। তাকে পানি দিলে সে কালেমা পড়ে মৃত্যুবরণ করে। পরে ঢাকা মেডিকেলে নিলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে। জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে ৫ লাখ টাকা, জেলা প্রশাসক থেকে দুই লাখ এবং জামায়াতে ইসলামের নেতাকর্মীরা ২ লাখ টাকা সহায়তা করেছেন। এসব টাকা জামালের স্ত্রী, সন্তান ও মায়ের নামে ব্যাংকে ডিপোজিট করে রাখা হয়েছে। এ ঘটনায় আমরা কোনো মামলা করিনি। কে বা কারা ভুয়া বাদী হয়ে এ ঘটনায় মামলা করেছে। আমরা এর সুষ্ঠু বিচার চাই।’
মন্তব্য করুন