এক সময় ব্যাংক লেনদেনের জন্য অবশ্যই সশরীরে উপস্থিত থাকতে হতো ব্যাংকের শাখায়। লাইনে দাঁড়িয়ে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই নিতে হতো সেবা। এখন প্রযুক্তি কল্যাণে যে কোনো সময় ব্যাংকে না গিয়েই করা যাচ্ছে ব্যাংক লেনদেন। পরিশোধ হচ্ছে বিল। কেনাকাটাও করা যাচ্ছে অনলাইনে। এক কথায় কয়েকটি ক্লিকেই হয়ে যাচ্ছে ব্যাংক লেনদেন। এতে ব্যাংকের লাইনে দাঁড়ানোর ঝামেলা এড়িয়ে বেঁচে যাচ্ছে সময়। নষ্ট হচ্ছে না কর্মঘণ্টা, আর এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সরকার এখন নগদহীন লেনদেন উদ্বুদ্ধ করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লক্ষ্য ২০২৭ সালের মধ্যে দেশের ৭৫ শতাংশ লেনদেনই ক্যাশলেস বা নগদহীন করা। এজন্য তৈরি করা হয়েছে বিনিময়, বাংলা কিউআরের মতো অ্যাপ। বিনিময় ব্যবহার করে এক ব্যাংক অন্য ব্যাংক বা এমএফএসের সঙ্গে লেনদেন করতে পারবে। আর বাংলা কিউআর ব্যবহার করে যে কোনো মুহূর্তেই পরিশোধ করা যাবে যে কোনো ধরনের বিল। তবে প্রযুক্তি ও নীতিগত ত্রুটির কারণে এই দুটি সেবা এখনো পুরোপুরি চালু করতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, অনলাইন বা ই-ব্যাংকিং দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। সময়ের চাহিদা মেটাতে প্রায় সব ব্যাংকই এখন ইলেকট্রনিক বা ডিজিটাল সেবার দিকে ঝুঁকছে। ফলে ঘরে বসে বা চলতি পথে, যে কোনো সময়েই আর্থিক লেনদেন করা যাচ্ছে। জীবন হয়ে গেছে সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্যময়। ইন্টারনেট ব্যাংকিং, কার্ড সেবা ও মোবাইল ব্যাংকিং—এ তিন মাধ্যমে সেবা ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুতই। ফলে যে কোনো ব্যাংকে টাকা পাঠানো, পরিষেবা মাশুল, টিকিট কেনা, স্কুল বেতন, প্রতি মাসের কিস্তির টাকা দেওয়াসহ সব ধরনের ব্যক্তিগত লেনদেন করা যাচ্ছে। আর কার্ড ও মোবাইল ব্যাংকিং তো রয়েছেই যে কোনো সময়ের নগদ টাকার চাহিদা মেটাতে। এসব সেবার নিরাপত্তা বাড়াতে দিনে দিনে যুক্ত হয়েছে আঙুল ও চোখের মাধ্যমে গ্রাহক যাচাই, কিউআর কোড, ব্লক চেইনসহ নানা প্রযুক্তি।
ইন্টারনেট ব্যাংকিং: দেশে চলমান সব ব্যাংকেই ইন্টারনেট ব্যাংকিং সেবা চালু করেছে। এ ব্যাংকিং অল্প সময়েই এ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এরই মধ্যে গ্রাহক দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮৫ লাখ। বাংলাদেশ ব্যাংকও এ সেবা আরও বড় পরিসরে চালু করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। আন্তঃব্যাংক লেনদেনের নেটওয়ার্ক বাড়ানো হচ্ছে। এতে রিয়েল টাইমে লেনদেনের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপসের মাধ্যমে গ্রাহকরা হিসাব খোলা, পরিবর্তন বা স্থানান্তর, বিল পরিশোধ, মোবাইল টপআপ, এটিএম ও শাখার লোকেশন, মিনি ও বিস্তারিত স্টেটমেন্ট, লেনদেনের সার্বিক বিবরণী, ঋণসংক্রান্ত তথ্য, ক্রেডিট কার্ডের বিল পরিশোধ, ব্যালান্স, বকেয়া দেনার হিসাব ও পরিশোধ সীমা ইত্যাদি জানতে পারছেন।
ইন্টারনেট ব্যাংকিং ব্যবহারকারীরা ইউজার আইডি, পাসওয়ার্ড ও ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ডের মাধ্যমে অ্যাপস ব্যবহার করছেন। একেক ব্যাংক একেক নামে অ্যাপস চালু করেছে। যেমন—স্মার্ট ওপেনার স্কাই ব্যাংকিং, আইসার, আইস্মার্ট, আলফা ইত্যাদি নামে রয়েছে এসব মোবাইল অ্যাপস। গ্রাহকরা তাদের স্মার্টফোনের মাধ্যমে এসব অ্যাপস ব্যবহার করতে পারছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, দেশে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ব্যাংকিং কার্যক্রম চালাচ্ছেন এমন গ্রাহকের সংখ্যা গত জানুয়ারিতে দাঁড়িয়েছে ৮৪ লাখ ৮৬ হাজার। এই গ্রাহকরা লেনদেন করেছেন ৯৬ হাজার ২০৬ কোটি টাকা।
৪ কোটি ২৯ লাখের বেশি ডেবিট, ক্রেডিট ও প্রিপেইড কার্ডে গত জানুয়ারিতে লেনদেন হয়েছে ৪৬ হাজার ১৮৮ কোটি টাকা। সারা দেশে এটিএম বুথ রয়েছে ১৩ হাজার ৫২৬। আর সারা দেশের ১১ হাজার ২৮৫ শাখার সবকটিই এখন অনলাইনের আওতায়। বর্তমানে দেশে ৬১ ব্যাংক কার্যক্রমে আছে। এগুলোর সবই অনলাইনে সেবা দিচ্ছে।
মোবাইল ব্যাংকিং: ঘরে বসেই দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে টাকা পাঠানো, বিল পরিশোধসহ নানা কারণে জনপ্রিয়তা বাড়ছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের (এমএফএস)। তৃণমূল পর্যায়ে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে এ সেবা। ক্রমেই এমএফএস প্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে লেনদেন। বাড়ছে গ্রাহক সংখ্যাও। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ১ লাখ ২৯ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে, যা এ যাবৎকালের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেকর্ড। একক মাসে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয় গত বছরের জুনে, ১ লাখ ৩২ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা। জানুয়ারিতে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে পাঠানো হয়েছে ৪০ হাজার ২২৮ কোটি টাকা। আর উত্তোলন হয় ৩৭ হাজার ৪০৪ কোটি টাকা। এ সময় ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি হিসাবে ৩৫ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বেতন-ভাতা বাবদ বিতরণ হয় ৪ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। এ ছাড়া বিভিন্ন পরিষেবার ২ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকার বিল পরিশোধ এবং কেনাকাটায় হয়েছে ৫ হাজার ৭৬৯ কোটি টাকা লেনদেন। এ ছাড়া ৫৯৩ কোটি টাকার প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স এসেছে।
২০২৪ সালের জানুয়ারি শেষে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে নিবন্ধিত গ্রাহক সংখ্যা ছিল ২১ কোটি ৯১ লাখ ৭৩ হাজার। গ্রাহকদের অনেকেই একাধিক সিম ব্যবহার করছেন। লেনদেনের সুবিধার্থে একাধিক সিমে হিসাব খুলছেন। নিবন্ধিত এসব হিসাবের মধ্যে পুরুষ গ্রাহক ১২ কোটি ৭১ লাখ ৮১ হাজার ও নারী ৯ কোটি ১৩ লাখ ৭৯ হাজার। এ সময়ে মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৩৯ হাজার ৩২১।
বিকাশের হেড অব করপোরেট কমিউনিকেশন্স শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম কালবেলাকে বলেন, ডিজিটাল লেনদেনের ইকোসিস্টেম দিন দিন বড় হচ্ছে। এমএফএস প্রভাইডাররা নতুন নতুন সেবা যুক্ত করছে। যে গ্রাহক আগে একটি-দুটি ট্রানজেকশন করতেন সেবা বৃদ্ধির কারণে তারা নতুন নতুন সেবা নিচ্ছেন। নতুন নতুন মার্চেন্ট যুক্ত হচ্ছেন আমাদের সঙ্গে। দেশে অনলাইন ব্যবসার বিস্তার ঘটছে। এর প্রভাবও পড়ছে। এ ছাড়া ব্যাংকগুলোও আমাদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। সব মিলিয়ে গ্রাহকরা এখন ক্যাশলেস লেনদেনের দিকে ঝুঁকছেন। ভবিষ্যতে এই প্ল্যাটফর্ম আরও বড় হবে বলে মনে করেন বিকাশের এই শীর্ষ কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১০ সালে মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু করে। ২০১১ সালের ৩১ মার্চ বেসরকারি খাতের ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের মোবাইল ব্যাংকিং সেবা রকেটের মধ্য দিয়ে দেশে এমএফএসের যাত্রা শুরু। এর পরই ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু করে বিকাশ। এ ছাড়া এখন নগদসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান এ সেবা দিচ্ছে। বর্তমানে বিকাশ, রকেট, ইউক্যাশ, মাই ক্যাশ, শিওর ক্যাশসহ নানা নামে ১৩টির মতো ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠান এমএফএস সেবা দিচ্ছে।
বিনিময়: মোবাইল ব্যাংকিং চালুর পর বর্তমানে দেশের বেশিরভাগ মানুষ এই সেবা নিচ্ছেন। তবে অন্য মোবাইল ব্যাংকিং সার্ভিস যারা দিচ্ছেন তাদের মধ্যে লেনদেন সম্ভব না হওয়ায় ভোক্তাদের একের বেশি মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট চালু রাখতে হতো। কারও হয়তো বিকাশ, রকেট বা এমক্যাশে অ্যাকাউন্ট আছে। চাইলেই একটি থেকে আর একটিতে টাকা লেনদেন করা যায় না। শুধু বিকাশ থেকে বিকাশ নম্বর অথবা রকেট থেকে রকেটেই টাকা লেনদেন করা যায়। এই সমস্যার সমাধান নিয়ে বাংলাদেশে চালু হয়েছে বাণিজ্যিক ব্যাংক, বিকাশ, রকেটের মতো মোবাইল ব্যাংকিং সার্ভিস এবং পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডারের ই-ওয়ালেটের মধ্যে আন্তঃলেনদেনের একটি প্ল্যাটফর্ম। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই উদ্যোগের নাম ‘বিনিময়’। এতদিন দু-একটি ব্যাংকের সঙ্গে মোবাইল ব্যাংকিং সার্ভিস থেকে টাকা লেনদেন করা যেত। এই সেবা পুরোপুরি চালু হলে যে কোনো ব্যাংক অন্য ব্যাংক বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে যে কোনো সময় লেনদেন করতে পারবে।
বাংলা কিউআর কোড: নগদ টাকা বহন ও উত্তোলনের ঝামেলা থেকে বাঁচতে প্রযুক্তি ব্যবহারকারী বেশিরভাগ গ্রাহকই কেনাকাটায় ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহারে পছন্দ করেন। এ ক্ষেত্রে সুপার শপ ও আউটলেটগুলোতে গেলেই দেখা যায় পস মেশিন বা কিউআর কোড। কিন্তু এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলোর আলাদা আলাদা কিউআর থাকায় ক্রেতা ও বিক্রেতাদের মধ্যে পেমেন্টে সমস্যা তৈরি হতো। এই সমস্যা সমাধানে সর্বজনীন ডিজিটাল লেনদেন করতে বাংলাদেশ ব্যাংক চালু করেছে বাংলা কিউআর কোড। এক কিউআর কোডের মাধ্যমেই গ্রাহক সব ধরনের মূল্য পরিশোধ করতে পারবেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ মাধ্যমটি চালুর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ক্যাশলেস ব্যবস্থাকে ত্বরান্বিত করা। বিনিময় অ্যাপের মাধ্যমে সব ধরনের পেমেন্ট প্রতিষ্ঠানকে একত্রিত করা গেলেও ওই পরিশোধ ব্যবস্থা ছিল ম্যানুয়াল। এজন্য কিউআর কোডে সহজেই পরিশোধের জন্যই বাংলাদেশ ব্যাংক বাংলা কিউআর কোড চালু করে। ‘সর্বজনীন পরিশোধ সেবায় নিশ্চিত হবে স্মার্ট বাংলাদেশ’ স্লোগান সামনে রেখেই এই সেবা চালু করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু নীতিগত ত্রুটির কারণে এই সেবা এখনো পুরোপুরি চালু করা যায়নি।