নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে ডলার কেনাবেচা করায় সাত মানি চেঞ্জারের লাইসেন্স স্থগিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি একই কারণে আরও ১০ মানি চেঞ্জারের কাছে ব্যাখ্যা তলব করা হয়েছে।
ব্যাংক ও খোলা বাজারে ডলারের বিনিময় হারের পার্থক্য গত কয়েক মাস স্বাভাবিক থাকার পর বর্তমানে তা আবারও বাড়তে শুরু করেছে। ব্যাংকগুলোতে ডলার ১০৯ টাকা থেকে ১১০ টাকায় বিক্রি হলেও খোলা বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ১১৭ থেকে ১১৮ টাকায়। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের বেধে দেওয়া নিয়ম অনুযায়ী, এখন খোলা বাজারে প্রতি ডলারের দাম ১১২ টাকা ৫০ পয়সার মধ্যে থাকার কথা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি ডলার বিক্রি করায় গত রোববার থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে খোলা বাজারে চলছে অভিযান। সেই অভিযানের পর গতকাল এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক। তিনি বলেন, ব্যাংকে ডলারের কোন সংকট নেই। বর্তমানে ব্যাংকগুলোতে ৩৩ মিলিয়ন ডলারের ক্যাশ ব্যালান্স আছে। তারপরও কেন মানুষ খোলাবাজারে যাচ্ছে, সেটি বড় বিষয়। তিনি বলেন, খোলা বাজারেও ডলারের দাম এতো বেশি বাড়ার কোন কারণ নেই। তারপরেও খোলাবাজারে ডলারের দাম বাড়ায় এই অভিযান চালানো হচ্ছে। এবং সেই অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে ৭টি মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে আর ১০টি মানি চেঞ্জারের কাছে ব্যাখ্যা তলব করা হয়েছে। ব্যাখ্যা পাওয়ার পর অন্যদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
লাইসেন্স স্থগিত করা সাত মানি চেঞ্জার হলো- ইয়র্ক মানি এক্সচেঞ্জ, জামান মানি চেঞ্জিং হাউস, জেনি মানি এক্সচেঞ্জ লিমিটেড, স্ট্যান্ডার্ড মানি এক্সচেঞ্জ, মার্সি মানি এক্সচেঞ্জ, জেবি মানি এক্সচেঞ্জ ও বেঙ্গল মানি এক্সচেঞ্জ। লাইসেন্স স্থগিত করার জন্য যেসব কারণ বলা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা লঙ্ঘন করে নির্ধারিত হারের চেয়ে বেশি দামে ডলার কেনাবেচা করা, বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ডলারের দামের অসত্য তথ্য জমা দেওয়া ও লাইসেন্সের শর্ত ভঙ্গ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নিয়মিত তথ্য জমা না দেওয়া।
ব্যাখ্যা তলব করা ১০ মানি চেঞ্জার হলো—নিউ প্রাইম মানি চেঞ্জার, উত্তরা মানি চেঞ্জার, মিসা মানি এক্সচেঞ্জ, যমুনা মানি এক্সচেঞ্জ, পাইওনিয়ার মানি এক্সচেঞ্জ, বুড়িগঙ্গা মানি এক্সচেঞ্জ, স্কাফ মানি চেঞ্জার, হযরত খাজা বাবা মুদ্রা বিনিময় কেন্দ্র, গ্লোরি মানি এক্সচেঞ্জ ও মাতৃক মানি চেঞ্জার।
এদিকে, গতকাল বুধবার রাজধানীর দৈনিক বাংলা মোড় ও গুলশানে চারটি মানি এক্সচেঞ্জে অভিযান চালিয়েছে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) ও বাংলাদেশ ফাইনান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট বিএফআইইউ ও সিআইডি। অভিযানে প্রায় দুই লাখ মার্কিন ও কানাডিয়ান ডলার এবং ৩৮ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। এসময় হুন্ডির কারবারে জড়িত একাধিক ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে বলেও জানা গেছে।
অভিযানে অংশ নেওয়া কর্মকর্তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী বুধবার দৈনিক বাংলা মোড়ে আরএস ভবনের দ্বিতীয় তলায় নিহন মানি এক্সচেঞ্জে অভিযান পরিচালনা চালায় এনএসআই ও বিএফআইইউ চালায়। অভিযানে এক লাখ ৭০ হাজার মার্কিন ডলার (১ কোটি ৯০ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা), ৩০ হাজার কানাডিয়ান ডলারসহ (২৬ লক্ষ ৫৫ হাজার টাকা) আরও কিছু বিভিন্ন দেশের মুদ্রা ও টাকা পাওয়া গেছে। এনএসআই ও বিএফআইইউয়ের অভিযানে হুন্ডির ক্যারিয়ার মিরাজুল ইসলামের কাছ থেকে নগদ ৩৮ লাখ ১৮ হাজার টাকাও পাওয়া গেছে। এই টাকা মানি এক্সচেঞ্জের মালিক শহীদের কাছে জমা দিতে এসেছিল মিরাজ। এ সময় তাকে তাকে হাতেনাতে ধরা হয়। এভাবে শহীদ হুন্ডির কারাবার চালিয়ে আসছিল বলে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা জানতে পেরেছেন। মালয়েশিয়াতে বসবাস করা গোপাল এই অর্থের মূল হোতা বলেও জানতে পেরেছেন তারা।
সূত্র মতে, মন্টু নামে এক ব্যক্তি মতিঝিল ও পল্টন এলাকার সব মানি এক্সচেঞ্জে বিদেশি মুদ্রা সরবরাহ করার একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। মন্টুর চক্রের সদস্য ওমর ফারুক নিহন মানি এক্সচেঞ্জে অর্থ সরবরাহ দিতে এসে ডলারসহ আটক হয়। জিজ্ঞাসাবাদে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, মন্টুর বাসা থেকে প্রতিদিন মানি এক্সচেঞ্জগুলোতে বিদেশি মুদ্রা সরবরাহ করা হয়। সন্ধ্যায় মন্টুর নয়া পল্টনের বাসায় সারাদিনের লেনদেন শেষে টাকা ও ডলার পৌঁছে দেওয়া হয়। গুলশান-বনানীতে অভিযান।
এদিকে বুধবার সকালে গুলশান-১-এর নাভানা টাওয়ারে সাব মানি এক্সচেঞ্জ ও লর্ডস মানি এক্সচেঞ্জ এবং গুলশান দুই-এর ল্যান্ডমার্ক টাওয়ারে মেট্রো মানি এক্সচেঞ্জে অভিযান পরিচালন চালায় এনএসআই ও বিএফআইইউ। লর্ডস মানি এক্সচেঞ্জে নির্ধারিত মূল্যের বেশি দামে ডলার কেনা-বেচা এবং নিয়ম বহির্ভূতভাবে না মেনে ডলার বিক্রির অনিয়ম পাওয়া যায়। পরবর্তীতে নিয়ম মেনে ব্যবসা পরিচালনার জন্য মালিকদের সতর্ক করে দিয়েছেন এনএসআই ও বিএফআইইউয়ের কর্মকর্তারা। অভিযানে নাভানা টাওয়ারের পেছনে শিহাব, মিরাজ, লিটন, তুষার, জিল্লুর, মিন্টু ও রাজিব নামের ব্যক্তিরা ব্যাগে করে বিদেশি মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয় করে সন্ধান পেয়েছে এনএসআই ও বিএফআইইউ কর্মকর্তারা। এদিকে মেট্রো মানি এক্সচেঞ্জে অভিযান চালিয়ে ১৫ থেকে ১৬ লাখ ছেড়া টাকা, অতিরিক্ত দামে ডলার বিক্রির অনিয়ম পেয়েছে অভিযান পরিচালনাকারী প্রতিনিধি দল।
ব্যাংকগুলোতে আবারও ডলারের সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষ ব্যাংকে গিয়ে প্রয়োজনীয় ডলার পাচ্ছে না। বাধ্য হয়েই তারা ডলারের প্রয়োজেনে খোলাবাজারে যাচ্ছে। আর এ সুযোগে ইচ্ছামতো দাম নিচ্ছে মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে দেশের খোলা বাজারে ডলারের দাম আবারও বেড়েছে। ব্যাংকগুলোতে ডলার ১০৯ টাকা থেকে ১১০ টাকায় বিক্রি হলেও খোলা বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ১১৭ থেকে ১১৮ টাকায়।
খোলা বাজার বা কার্ব মার্কেটের ব্যবসায়ীরা বলছেন, খোলাবাজারে ডলারের চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় সংকট তৈরি হয়েছে। প্রবাসীদের দেশে আসা কমেছে, বিদেশি পর্যটকরাও কম আসছেন। এ কারণে ডলারের সরবরাহ কম। এছাড়া, খোলাবাজার থেকে যে কেউ ডলার কিনতে পারেন। ব্যাংক থেকে কিনতে পাসপোর্ট এনডোর্সমেন্ট করতে হয়। যে কারণে অনেকে এখন খোলাবাজার থেকে ডলার কিনতে আসেন। ফলে চাহিদা ও যোগানের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে।
ব্যাংকে ডলারের মজুত কম, এর দাম নির্ধারণ ও বিদেশে যাওয়া শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি হুন্ডির মাধ্যমে লেনদেন বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। এতে রেমিট্যান্স প্রবাহে বিরূপ প্রভাব পড়বে বলেও আশংকা করছেন তারা। এই অবস্থায় খোলাবাজারে ডলারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি রোধে অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ ও খোলাবাজারে ডলার কেনাবেচা বন্ধ করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। কেননা খোলাবাজারে দাম বেড়ে গেলে অবৈধ পথে প্রবাসী আয় আসা বেড়ে যায়। আবার অবৈধ পথে আয় আসা বেড়ে গেলে অর্থ পাচারও বেড়ে যায়। তাই অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি করে কেউ সুযোগ নিচ্ছে কি না, তা–ও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা।
মন্তব্য করুন