কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ১০:৫৯ পিএম
আপডেট : ০৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ১১:০৫ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

‘রিজার্ভ সংকটে বৈদেশিক মুদ্রার অবাধ প্রবেশের সুযোগ থাকা উচিত’

সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম। পুরোনো ছবি
সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম। পুরোনো ছবি

বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক ‍মুদ্রানীতি অনুযায়ী, বিদেশ থেকে যে কোনো কোনো ব্যক্তি ঘোষণা ছাড়া সর্বোচ্চ ১০ হাজার ডলারের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আনতে পারেন। তবে এর বেশি আনতে গেলে বন্দরে এসে একটি নির্দিষ্ট ফরমে ঘোষণা দিতে হয়। ঘোষণার স্বপক্ষে অর্থের উৎসের প্রমাণাদি দিতে হয়। তবে বর্তমান রিজার্ভ সংকট কাটাতে মুদ্রনীতি এই অংশের ধারাটি তুলে দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন সদ্য সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম।

তিনি বলেন, এখন বিদেশ থেকে কেউ আসার সময় ১০ হাজার ডলারের বেশি আনলে তাকে বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। কিন্তু এটা কেন করা হয় জানি না। আমার মতে, এখন এটা রহিত করার কথা ভাবা যায়, এখন ভাবা দরকার। কারণ এখন আমাদের রিজার্ভ সংকট রয়েছে। বিদেশ থেকে বেসরকারি খাতের ঋণ গ্রহণে কিছু সময়ের জন্য নিষেধাজ্ঞা আরোপেরও সুপারিশ করেন তিনি।

শনিবার রাজধানীর একটি হোটেলে বিআইডিএসের তিন দিনের সম্মেলনের শেষ অধিবেশনে এসব কথা বলেন তিনি। অর্থনীতির নীতি চ্যালেঞ্জ নিয়ে এই অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এতে সাবেক মন্ত্রী, আমলা, অর্থনীতিবিদ, গবেষকেরা অংশ নেন। সভাপতিত্ব করেন বিআইডিএস মহাপরিচালক বিনায়ক সেন।

ড. শামসুল আলম বলেন, দেশে বর্তমান রিজার্ভ সংকট রয়েছে, এটা আমরা সবাই জানি। যদিও ধীরে ধীরে স্থিতিশীল হয়ে আসছে। এই মুহূর্তের দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আসা উচিত। কারণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখার পাশাপাশি রিজার্ভ বাড়াতেও সহায়তা করে। সেখানে বিদেশ থেকে আসার সময় বৈদেশিক মুদ্রার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা উচিত না।

শুধু বৈদেশিক মুদ্র না, স্বর্ণের বার আনার ক্ষেত্রেও বিধিনিষেধ তুলে দেওয়া উচিত বলে মনে করেন শামসুল আলম। তিনি বলেন, স্বর্ণ বার এবং কয়েন দেশের সম্পদ বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে মূল্য সংযোজন করে। এ বিষয়ে অনেকে বলতে পারেন এটার অবাধ সুযোগ দিলে ভারতে পাচার হয়ে যাবে।

অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার বিষয়ে সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, যেহেতু অর্থনীতি এখন কিছুটা অস্থিতিশীলতার মধ্যে আছে। তাই বিদেশি ঋণ নেওয়ার সময় কিছুটা সতর্ক থাকতে হবে। বিদেশ থেকে বেসরকারি খাতের ঋণ গ্রহণে কিছু সময়ের জন্য নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার সুপারিশও করেন তিনি।

ঋণ পরিশোধ না করা কালচার হয়ে দাঁড়াচ্ছে

ঋণ পরিশোধ না করা সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়াচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। তিনি বলেন, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করা লাগবে না; এমন চিন্তা একটি সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। ব্যাংকের ঋণখেলাপি সমস্যা এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলেও জনাান তিনি।

সম্মেলনে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে গভর্নর আরও বলেন, ব্যাংকগুলোতে সুশাসন এবং অপর্যাপ্ত সম্পদও একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে ঝুঁকি নিরসনে ঝামেলা হচ্ছে। ঋণখেলাপি কমানোর জন্য একটি রোডম্যাপ তৈরি হয়েছে জানিয়ে গভর্নর বলেন, এটা নিয়ন্ত্রণে সামনে থেকে আমরা বেশকিছু পদক্ষেপ শুরু করব। কারা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি তা চিহ্নিত করার চেষ্টা করছি আমরা।

তিনি বলেন, ব্যাংক খাতে এই মুহূর্তে তিনটি সমস্যা আছে। এগুলো হলো- সুশাসনের অভাব, খেলাপি ঋণ এবং ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার এভাবেই ব্যাংক খাতের সমস্যা চিহ্নিত করেছে।

আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, মূলত চার কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। ব্যাংকগুলোতে সুশাসনের অভাবে অনেক ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। এ ছাড়া বহু পুরোনো খেলাপি ঋণ আছে। বছরের পর বছর এসব ঋণখেলাপি হয়ে আছে। অন্যদিকে ঋণখেলাপি হওয়ার সংস্কৃতিও আছে। তাদের মনোভাব এমন, ঋণ নিয়ে তা ফেরত না দিলেও চলবে। সর্বশেষ কারণ হলো, কিছু ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়ার ফলে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। খেলাপি ঋণ কমাতে আমরা পরিকল্পনা করছি।

সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, বর্তমান মূল্যস্ফীতির কারণ উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া। চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে এই মূল্যস্ফীতি হয়নি। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য হলেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা উচিত। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর জানান, আগামী জুন মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ছয় শতাংশে নেমে আসবে। ব্যাংক খাত থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে প্রতিদিন ৭০০-৮০০ কোটি টাকা ঢুকছে। ঋণ আরও খরুচে করা হয়েছে। এতে গত মাসে মূল্যস্ফীতি কমেছে।

বিআইডিএস মহাপরিচালক বিনায়ক সেন বলেন, আশির দশকে আমরা বলতাম, ব্যাংকের পরিচালক হবেন এই খাতের অভিজ্ঞরা। রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংকের পরিচালক হবেন না। কিন্তু এখন শুনি, ৯৫ বছর বয়সী একজন নারীকে ব্যাংকের পরিচালক বানানো হয়েছে। এটি খুবই দুর্ভাগ্যজনক।

পেঁয়াজ আমদানি নিয়ে দিল্লির সঙ্গে যোগাযোগ

ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ায় দেশের বাজারে তাৎক্ষণিকভাবে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে বলে মনে করেন সিনিয়র বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ। তিনি বলেন, প্রতি বছর বাংলাদেশকে সাত লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। ভারত রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ায় এর প্রভাব পড়েছে। তবে দুই দেশের সরকারের মধ্যে দর কষাকষির মাধ্যমে পেঁয়াজ আমদানি করা যেতে পারে। ইতিমধ্যে আমরা দিল্লির সঙ্গে কথা বলেছি।

তপন কান্তি ঘোষ বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আলু, ডিম, মুরগি আমদানি বন্ধ আছে। আমদানি বন্ধ থাকলে এবং উৎপাদন কমে গেলে বাজারে সরবরাহ বিঘ্নিত হয়। তখন এসব খাতের ব্যবসায়ীরা সুবিধা নিতেই পারেন। আবার এসব পণ্য আমদানি বন্ধ করার উদ্দেশ্য হলো, দেশে উৎপাদন বাড়িয়ে স্বয়ংসম্পন্ন হওয়া। তিনি আরও বলেন, বাইরে নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞার কথা শোনা যায়। এটা নিয়ে বেশি কথা বলব না। আমরা নানা ধরনের সংস্কার করছি।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, পেঁয়াজের দাম কেন বাড়ল, তা ভালোভাবে ব্যাখ্যা করেছেন বাণিজ্য সচিব। কিন্তু সাধারণ মানুষ তো বাজারে গিয়ে বেশি দামে পেঁয়াজ কিনতে হচ্ছে। মানুষ তো এসব ব্যাখ্যা বুঝবে না। অন্যদিকে ব্যাংকে খেলাপি ঋণ কীভাবে কমানো হবে, সেই বিষয়ে সমাধান কি জানতে চাই।

নির্বাচনের পর দরকার বড় সংস্কার

নির্বাচনের পর শক্তিশালী অর্থনৈতিক সংস্কার করার তাগিদ দিয়েছেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। তার মতে, আর্থিক খাতের প্রায় সব জায়গায় ব্যবস্থাপনার সমস্যা আছে। এজন্য অর্থনীতি ভুগছে। নির্বাচনের পর সংস্কারের জন্য ক্ষমতাসীনদের একটি শক্তিশালী দল করা উচিত। ওই দলকে ক্ষমতা দেওয়ার পাশাপাশি জোর করে সংস্কারের মনোভাব থাকতে হবে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) যেসব সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছে, সেসব সংস্কার নিজেদের প্রয়োজনেই করা উচিত। তার মতে, মুদ্রা বিনিময় হার, সুদের হার, মূল্যস্ফীতি- এসব ঠিক করা জরুরি। এটি তাৎক্ষণিক সংস্কার। আর মধ্যমেয়াদে রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে। ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপের (ইআরজি) নির্বাহী পরিচালক সাজ্জাদ জহির বলেন, সংস্কারের জন্য প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করতে হবে। একটি ভাবাদর্শের ভিত্তিতে এই সংস্কার হওয়া উচিত। তিনি আরও বলেন, সংসদে দ্বৈত নাগরিক বসে থাকবেন, তিনি ঋণ পেতে আগ্রহী হবেন। এই ঋণ সহজে দেশের বাইরে চলে যাবে।

সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় নির্বাচনের পরে রাজনৈতিক সদিচ্ছা লাগবে। কিন্তু এ বিষয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছ থেকে কোনো পরিকল্পনা দেখছি না। তাহলে কীভাবে সংস্কার হবে? খেলাপি ঋণ কমছে না, বরং বাড়ছে, কোনো উন্নতি দেখছি না। আবার অনেক সময় নিয়মের মধ্যেই ঋণখেলাপি হচ্ছে, তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু করার থাকে না। রাজস্ব খাতের সংস্কারে অনেক সময়ে রাজস্ব প্রশাসন থেকেই বাধা আসে বলেও মন্তব্য করেন সেলিম রায়হান।

বর্তমান সংকট মোকাবিলায় নীতি নির্ধারণে সরকারি-বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণে একটি স্বতন্দ্র ও স্বাধীন কমিটি গঠন করা উচিত বলে মত দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারপারসন মাসুদা ইয়াসমিন।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

যোগ করা সময়ে গোল খেয়ে লিড হারাল বাংলাদেশ

বাংলাদেশকে বড় ‘সুখবর’ দিল যুক্তরাজ্য

বিসিএস পরীক্ষার্থীদের জন্য বাসের ব্যবস্থা করল জবি প্রশাসন 

অর্থবছর শেষে কমেছে জিডিপি প্রবৃদ্ধি

মধুমতীতে বিলীন ১৪ ব্যারাক, আরও ৩টি অতিঝুঁকিতে

ভাঙার দুই দিনেও মেরামত হয়নি বেড়িবাঁধ, তলিয়েছে ঘরবাড়ি

শহীদ মীর মুগ্ধের জন্মদিনে ভাই স্নিগ্ধের আবেগঘন পোস্ট

ঢাকায় ১০ লাখ শিশুকে টাইফয়েড টিকাদানের লক্ষ্যমাত্রা, নিতে পারবে নিবন্ধন ছাড়াও

২৮ বছরের ক্রিকেট ইতিহাস নতুন করে লিখলেন ভারতীয় ওপেনার

হামাস-ইসরায়েলের সংলাপকে স্বাগত জানিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তি

১০

‘আইয়া দেখি মা-বাবাকে মাইরা খাটের ওপর বইসা রইছে’

১১

নওগাঁর সাবেক এমপি ওমর ফারুক কারাগারে

১২

হামজাদের খেলা দেখতে গেট ভেঙে স্টেডিয়ামে ঢুকলেন দর্শক

১৩

শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আমদানিকালে ৭৫ হাজার কেজি সুতা জব্দ

১৪

মায়ের লাশ আটকে সম্পত্তি ভাগ-বাটোয়ারা, ২০ ঘণ্টা পর দাফন

১৫

ভিনিসিয়ুস জুনিয়রের বাড়িতে অগ্নিকাণ্ড

১৬

সন্ত্রাসবিরোধী আইনে বাংলাদেশে নতুন করে দমন-পীড়ন : এইচআরডব্লিউ

১৭

রাকসু নির্বাচন / ১৬ দফার ইশতেহার দিল গণতান্ত্রিক শিক্ষার্থী পর্ষদ

১৮

ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা, তিন দিন পরও হয়নি মামলা

১৯

হঠাৎ খুমেকে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের কর্মবিরতি, বিপাকে রোগীরা

২০
X