এনবিআর বিলুপ্তির অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে কর্মবিরতির কর্মসূচি পালন করছে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ। শনিবার (২৪ মে) ভিন্নভাবে কেটেছে আন্দোলনকারীদের।
এদিন সকাল থেকে আগারগাঁওয়ের রাজস্ব ভবনে অবস্থান নেন সেনাবাহিনী-বিজিবি ও পুলিশ সদস্যরা। আর তাদের নিয়ে এসেছেন এনবিআরের বোর্ড প্রশাসন। যদিও আন্দোলনকারীরা এর নেপথ্যে এনবিআরের বর্তমান চেয়ারম্যান ও সরকারের এক প্রভাবশালী সচিবকে ইঙ্গিত করছেন। তারা আরও বলছেন, এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ শুরু থেকে আন্দোলন কর্মসূচি পালন করছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। এরই মধ্যে শনিবার (২৪ মে) বিকেল চারটায় সংবাদ সম্মেলন করেন আন্দোলনকারীরা। তারা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত কর্মসূচি চালিয়ে যাবেন বলেও জানান।
সরেজমিনে এনবিআর ঘুরে দেখা গেছে, সকাল থেকে রাজস্ব ভবনের সামনে অবস্থান নেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। সেনাবাহিনী থেকে শুরু করে বিজিবি ও পুলিশ সদস্যদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। রাজস্ব ভবনের গেট বন্ধ করে আইডি কার্ড দেখে প্রবেশ নিশ্চিত করেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। আর রাজস্ব ভবনের সামনেই রাখা ছিল পুলিশের একটি সাঁজোয়া যান। এনবিআর অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলনে প্রথমবারের মতো রাজস্ব ভবনে আসেন তারা।
রাজস্ব ভবনের নিচতলায় এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পাশেই ছিল তাদের অবস্থান। এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সংবাদ সম্মেলন শেষ হওয়ার পর বিকেল প্রায় পৌনে পাঁচটায় বেরিয়ে যান সেনাবাহিনী-বিজিবি ও পুলিশ সদস্যরা। বিশৃঙ্খলা এড়াতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের এনবিআরে নিয়ে আসা হয়েছে বলে জানিয়েছেন এনবিআরের বোর্ড প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারের অতিরিক্ত সচিব খালিদ আহমেদ।
তিনি বলেন, এনবিআরে যাতে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা তৈরি না হয়, সেজন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিয়ে আসা হয়েছে। কারা বিশৃঙ্খলা করতে পারে এমন প্রশ্নে জবাবে এনবিআরের এই সদস্য জানান, আন্দোলনকারীরাও করতে পারে আবার বহিরাগতরাও করতে পারে। আর সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের এনবিআরে আনা হয়েছে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে পূর্বঘোষিত কর্মবিরতি স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালিত হয়েছে। এদিন সারা দেশের কাস্টম-ভ্যাট ও ট্যাক্সের অফিসগুলো ছিল কার্যত বন্ধ। ব্যাহত হয়েছে রাজস্ব কার্যক্রম। যদিও আন্দোলনকারীরা রাজস্ব আহরণ কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
একইসঙ্গে তারা বলছেন, দাবি আদায়ে সরকারের ঘোষণা আসামাত্র কাজে যোগ দেবেন এবং নির্ধারিত অফিস আওয়ারের বাইরে কার্যক্রম চালু রেখে এই সাময়িক ক্ষতি দূর করে দিবেন। কিন্তু রাজস্ব ভবনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতি নিয়ে তাদের মধ্যে নানা ধরনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে। তারা বলছেন, শুরু থেকেই ঐক্য পরিষদ শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করে আসছে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে চলবে। আর রাজস্ব ভবনে সরকারের দুটি ক্যাডার ও এনবিআরের সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীর এই আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ডাকা নিয়েও অজানা শঙ্কা তৈরি হয়েছে বলেও জানান তারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কাস্টম-ট্যাক্সের কর্মকর্তারা কালবেলাকে জানিয়েছেন, রাজস্ব ভবনে বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের ডেকে এই যৌক্তিক আন্দোলনকে বিতর্কিত করার চেষ্টাও হতে পারে। তবে এর পেছনে অপসারণ চাওয়া এনবিআর চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান ও সরকারের আরেক প্রভাবশালী সচিব এটা করতে পারেন বলেও অভিযোগ করছেন। তারা আরও অভিযোগ করছেন, এনবিআরে কর্তৃত্ব তৈরি করতে চাওয়া কর্মকর্তারাই এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করতে পারেন বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করছেন আন্দোলনকারীরা। দাবি আদায় না হলে আরও কঠোর কর্মসূচির চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে বলেও জানান কর্মকর্তারা।
এদিকে, পরিপূর্ণ দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ কর্মবরিতিসহ পূর্বঘোষিত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ। শনিবার (২৪ মে) রাজস্ব ভবনে এনবিআর ঐক্য সংস্কার পরিষদেরর এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানানো হয়।
ব্রিফিংয়ে এদিন কথা বলেন কাস্টমসের অতিরিক্ত কমিশনার এদিক বিল্লাহ, উপ-কর কমিশনার মো. মোস্তফিজুর রহমান, সহকারী কর কমিশনার মো. ইশতিয়াক হোসেন। সংগঠনটির পক্ষ থেকে তারা বলেন, রোববার কাস্টমস হাউস ও এলসি স্টেশন ছাড়া আয়কর, কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগের সব দপ্তরে পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতি চলবে। এদিন কাস্টমস হাউস এবং এলসি স্টেশনগুলোতে সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত কর্মবিরতি চলবে। আর আগামীকাল সোমবার আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা ব্যতীত আয়কর, কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগের সব দপ্তরে পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতি চলবে।
তারা আরও বলেন, যেহেতু আমাদের উপর্যুক্ত চারটি সুনির্দিষ্ট দাবি পূরণের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে অদ্যাবধি সুস্পষ্ট ঘোষণা দেওয়া হয়নি, সেহেতু আমাদের পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, আপনারা দেখেছেন আজকে সকাল থেকেই এনবিআর ভবনের অভ্যন্তরে এবং বাইরে বিপুলসংখ্যক পুলিশ, বিজিবি, র্যাব ও সেনাবাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি রয়েছে। এ বিষয়টি আমাদের মনে নানা ধরনের প্রশ্নের উদ্রেক করেছে।
এতে আরও বলা হয়, দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থাপনা স্বাভাবিক রাখা এবং অর্থবছরের শেষ প্রান্তে রাজস্ব আহরণ কার্যক্রম সচল রাখার স্বার্থে আমাদের মূল চারটি দাবি পূরণের বিষয়ে সুস্পষ্ট ঘোষণা দেওয়ার জন্য আমরা সরকারকে সবিনয়ে অনুরোধ জানাচ্ছি। দাবি পূরণের ঘোষণা আসার সঙ্গে সঙ্গে আমরা কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেব।
এনবিআর কর্মকর্তাদের দাবিগুলো হলো- জারিকৃত অধ্যাদেশ অবিলম্বে বাতিল করতে হবে। অবিলম্বে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানকে অপসারণ করতে হবে। রাজস্ব সংস্কারবিষয়ক পরামর্শক কমিটির সুপারিশ জনসাধারণের জন্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক প্রস্তাবিত খসড়া এবং পরামর্শক কমিটির সুপারিশ আলোচনা-পর্যালোচনাপূর্বক প্রত্যাশী সংস্থা, ব্যবসায়ী সংগঠন, সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক নেতৃত্বসহ সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনের মতামত নিয়ে উপযুক্ত ও টেকসই রাজস্ব ব্যবস্থা সংস্কার নিশ্চিত করতে হবে।
মন্তব্য করুন