দীর্ঘদিন ধরে উচ্চমাত্রার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখা সত্ত্বেও দক্ষিণ এশিয়া আজ ঝুঁকির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। আঞ্চলিক অর্থনৈতিক হাল নিয়ে করা বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ রিপোর্ট থেকে এমন তথ্য জানা গেছে।
মূলত বৈশ্বিক উষ্ণায়নের সমাধান হিসেবে বিশ্বজুড়ে জ্বালানি শক্তির যে রূপান্তর চলছে এতে অংশগ্রহণ করে এ অঞ্চলে উচ্চ প্রবৃদ্ধি বজায় রাখার ব্যাপক সম্ভাবনার প্রতিও এ রিপোর্ট আলোকপাত করেছে।
এ রিপোর্টের প্রেক্ষাপটে গত ৩০ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অফ গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এবং বিশ্বব্যাংক আয়োজিত দুই দিনের সম্মেলনের বিষয় ছিল টুওয়ার্ড ফাস্টার, ক্লিনার গ্রোথ। সম্মেলনটি গবেষক, নীতিনির্ধারক, ও উন্নয়নকর্মীদের জন্য এ অঞ্চলে সবুজ বৃদ্ধির বা Green Growth-এর সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে গবেষণার আলোকে কার্যকরী আলোচনা করার একটি সুযোগ করে দিয়েছে।
বৈশ্বিক জ্বালানি শক্তি রূপান্তরের সুযোগ ব্যবহার করে দক্ষিণ এশিয়ায় উৎপাদনশীলতা ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যেতে পারে, বায়ুদূষণ হ্রাস করা যেতে পারে। এ ছাড়া জ্বালানি আমদানির ওপর নির্ভরতা কমানো যেতে পারে।
অথচ এ সুযোগ নিয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে যেসব কার্যক্রম নেওয়া প্রয়োজন, দক্ষিণ এশিয়ার সরকারগুলোকে সে কাজগুলো সীমিত রাখতে হয় মন্থর হয়ে আসা প্রবৃদ্ধি এবং আর্থিক চ্যালেঞ্জের কারণে। কিন্তু আর্থিক বিনিয়োগের ক্ষমতা সীমিত থাকলেও এ বিষয়ে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলো বিভিন্ন কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারে। যেমন সহায়ক বাজারনীতি, তথ্যপ্রচার, অর্থায়নের সুবিধা এবং নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎব্যবস্থা প্রণয়ন করার মাধ্যমে সরকার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎসাহিত করতে পারে বিভিন্ন জ্বালানি রূপান্তর প্রযুক্তি যেমন দক্ষ শক্তির প্রযুক্তি গ্রহণে।
শক্তি দক্ষতার উন্নতি দক্ষিণ এশিয়ায় অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত, উভয় লক্ষ্যের অগ্রগতি ত্বরান্বিত করতে পারে। প্রতি ইউনিট অর্থনৈতিক উৎপাদনের জন্য এই অঞ্চলে বৈশ্বিক গড় শক্তির দ্বিগুণ ব্যবহার হয়, যা পরিবেশে ও অর্থনীতির জন্য সমানভাবে ক্ষতিকর। যদিও দক্ষিণ এশিয়ার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো নানারকম প্রাথমিক পর্যায়ের শক্তি-দক্ষ প্রযুক্তি উৎসাহের সঙ্গে গ্রহণ করেছে, আরও উন্নত ও নতুন প্রযুক্তি গ্রহণে তার পিছিয়ে রয়েছে। প্রণোদনা পেলে তারা এক্ষেত্রে এগিয়ে যাবে।
আমাদের পোশাকশিল্প কারখানাগুলো সারা বিশ্বের সবুজায়িত কারখানাগুলো মধ্যে সেরা উল্লেখ করে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, সবুজ উন্নয়নে বাংলাদেশে অভূতপূর্ব অগ্রগতি হয়েছে।
তিনি এ সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
মান্নান বলেন, ‘বাংলাদেশের এনার্জি এফিশিয়েন্সি অ্যান্ড কনজারভেশান মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী দেখানো পথেই আমাদের চলতে হবে। এ পরিকল্পনায় বৃহৎ শিল্প ও জ্বালানি শক্তি ব্যবহারকারী, আবাসিক গ্রাহক, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সরকারি সংস্থা কীভাবে শক্তি-দক্ষতা অর্জন করতে পারে, তার উল্লেখ রয়েছে।’
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ও ভুটানের কান্ট্রি ডিরেক্টর আব্দুলায়ে সেক বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।’
তিনি বলেন, ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগের তীব্রতা এবং প্রবণতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশকে অবশ্যই পরিবেশ ও জলবায়ুসংক্রান্ত ঝুঁকি মোকাবিলায় আরও বেশি সক্রিয় হতে হবে। একইসঙ্গে দেশের চলমান শক্তিশালী প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে আরও অনেক পদক্ষেপ নিতে হবে। সবুজ প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশকে জলবায়ু ঝুঁকির বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিস্থাপকতা গড়ে তুলতে এবং উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করতে পারে।’
জ্বালানি শক্তির এ রূপান্তর দক্ষিণ এশিয়ার শ্রমবাজারকে নতুন রূপ দিতে পারে। এ অঞ্চলের প্রায় এক-দশমাংশ শ্রমিক দূষণের আশঙ্কাযুক্ত কাজে নিযুক্ত। এ কাজগুলো স্বল্পদক্ষ এবং প্রান্তিক শ্রমিকরা করে থাকে। তারা সাধারণত পেটের দায়ে এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে যায়। যদিও শক্তির রূপান্তর এ ধরনের প্রান্তিক মানুষের জন্য নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারে, এ রূপান্তরের ফলে অনেকে ওই সব ক্ষয়িষ্ণু শিল্পে আটকে থাকতে পারে ও নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হতে পারে।
প্রতিবেদনে তাদের সুরক্ষার জন্য বিস্তৃত নীতির সুপারিশ করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে উচ্চমানের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, অর্থায়ন ও বাজার সুবিধা; কর্মীদের গতিশীলতা সহজতর করা এবং সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা শক্তিশালী করা।
বিআইজিডির নির্বাহী পরিচালক ইমরান মতিন বলেন, ‘এ সম্মেলনে আমরা সবুজ-বৃদ্ধির এজেন্ডার ওপর জোর দিয়েছি এবং কী ধরনের পরিকল্পনা ও নীতি গ্রহণ করে আমরা এ এজেন্ডাটি এগিয়ে নিতে পারি সে সম্পর্কে গভীর অনুসন্ধান করার চেষ্টা করেছি।’
তিনি বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের বিপুল জনসংখ্যা এবং জনসংখ্যার বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করলে সবুজ-বৃদ্ধির এজেন্ডা শুধু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। বরং এই এজেন্ডাকে কেন্দ্র করে উদ্ভাবন উৎসাহিত করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ এবং আমরা সেদিকেই এগিয়ে যেতে চাচ্ছি। তবে সবুজ-বৃদ্ধি এজেন্ডা কখনোই বাস্তবয়ন হবে না যদি না তা একই সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পারে। তাই এ বিষয়টি বুঝতে আমাদের ভৌত ও সমাজবিজ্ঞানের সম্মিলিত জ্ঞানের ব্যবহার করতে হবে, যেমন প্রযুক্তি, অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান। তবেই অন্তর্ভুক্তিমূলক সবুজ সমৃদ্ধি সম্ভব হবে।’
মন্তব্য করুন