দেবাশীষ মন্ডল আশীষ, নেছারাবাদ (পিরোজপুর) প্রতিনিধি
প্রকাশ : ১৩ জুলাই ২০২৪, ১২:০১ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

কচুরিপানায় কৃষকের স্বপ্নবুনন

ভাসমান সবজি চাষ করে তাক লাগিয়েছেন বলদিয়া ইউনিয়নের গগন গ্রামের কৃষকরা। ছবি : কালবেলা
ভাসমান সবজি চাষ করে তাক লাগিয়েছেন বলদিয়া ইউনিয়নের গগন গ্রামের কৃষকরা। ছবি : কালবেলা

আধুনিক প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় যখন দেশে কৃষিতে বিপ্লব ঘটিয়েছেন কৃষিবিদরা। তৈরি করেছেন চাষাবাদের জন্য ট্রাক্টরসহ বিভিন্ন বীজ বপনযন্ত্র ঠিক তখনই কোনো প্রযুক্তির ব্যবহার না করেই শুধু কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে বহুমুখী সবজি চাষ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন পিরোজপুর জেলার নেছারাবাদ উপজেলার বিলাঞ্চল নামে খ্যাত বলদিয়া ইউনিয়নের গগন গ্রামের কৃষকরা। আধুনিকতা তাদের স্পর্শ করতে পারেননি। সকালে দেশীয় কৃষি কাজের যন্ত্রপাতি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন তারা। খালে বিলে ভেসে বেড়ানো কচুরিপানাকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করছেন ভাসমান সবজি বেড।

বর্তমানে কৃষকরা ভাসমান বেড তৈরির কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। আষাঢ়-শ্রাবণ মাস আসলেই পানির দেখা মেলে। আর এ নতুন পানি পেয়েই কৃষকদের এই কাজের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। ভাসমান বেডের ওপর উৎপাদিত কৃষি সবজি নিয়েই মিয়ারহাট-স্বরূপকাঠিসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঐতিহ্যবাহী এ ভাসমান সবজির বাজার মেলে।

ভাসমান সবজি চাষি সোহেল আহমেদ জানান, কচুরিপানার ঘন, লম্বা ও পুরস্তরের ওপর একটি নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যের বাঁশ ফেলে এ বেড তৈরি করা হয়। এরপর বাঁশের ওপর দাঁড়িয়ে শরীরের ভারসাম্য ঠিক রেখে দু’পাশ থেকে কচুরিপানা টেনে এনে বাঁশের উপর স্থরে স্থরে সাজাতে হয়। কচুরিপানার স্থর সাজানোর সময় কচুরিপানা পানিতে যেভাবে থাকে সেভাবে ঘন করে অর্থাৎ খাড়া করে সাজাতে হবে। পরবর্তী অর্ধেক স্তর সজানোর সময় কচুরিপানা উল্টো করে সাজাতে হবে অর্থাৎ এর শিকড় উপরের দিকে থাকতে হবে। তারপর পা দিয়ে চেপে চেপে উঁচু স্তর তৈরি করতে হবে যাতে কোনো গ্যাপ বা ফাঁকা জায়গা না থাকে। এরপর স্তুপের ওপরে উঠে প্রয়োজনীয় কচুরিপানা তুলে মাপ অনুযায়ী ধাপ তৈরি করতে হবে। ধাপের উপরের অংশে অপেক্ষাকৃত ছোট কচুরিপানা, খুদি পানা, টোপা পানা দেয়া ভাল। বন্যা, ঢেউ বা জোঁয়ার-ভাটার স্রোত থাকলে বেডের মাঝামাঝি জায়গায় বাঁশের খুঁটি বা বেডের চারপাশে ফ্রেম দিতে হবে।

তিনি আরও জানান, ভাসমান বেড তৈরির পর উপরিভাগ আবাদ উপযোগী হতে প্রায় ১৫-২০ দিন সময় লাগে। বেড তৈরির পর তাতে সারি করে সরাসরি বীজ বোনা যায়। আবার বল বা বিড়ায় তৈরি করা চারা নির্দিষ্ট দূরত্বে বেডে রোপণ করা যায়। আদা, হলুদ, কচু প্রভূতি ফসল সরাসরি রোপণ করা যায়। চারা ৫-৬ ইঞ্চি হলে এবং শিকড়ের মাথা বল থেকে বের হলেই (কালো হওয়ার আগেই) বেডে লাগাতে হবে। বিড়া বা ব্যাগের চারা একত্রে বেডে নির্দিষ্ট পরিমান গর্ত করে রোপণ করতে হবে। বিড়ার আকার ছোট হলে পার্শ্বে পচা কচুরির আস্তরণ দিতে হবে। নতুন আস্তরণের সাথে ১-২ চা চামচ জৈব সার প্রয়োগ করলে চারা তাড়াতাড়ি বাড়বে। চারা লাগানোর পর সামান্য পানি দিয়ে চারা ও চারার গোড়া ভিজিয়ে দেয়া আবশ্যক। চারা বেশি লম্বা হলে বাউনি দিতে হবে। অধিক ফলন পাওয়ার জন্য ভাসমান বেডে ঢেঁড়শ, টমেটো, বেগুন, কলমিশাক ইত্যাদি ফসলের সাথে আন্ত-ফসল ও মিশ্র ফসল হিসেবে ঝিঙ্গে, লালশাক, পুঁইশাক, ধনিয়া, ডাঁটা প্রভূতি চাষ করা যায়। তাছাড়াও এই অঞ্চলের পানি কচু দেশের বিভিন্ন জেলা ও প্রত্যন্ত গ্রামের বাজারগুলোতে পাওয়া যায়।

সবজি ব্যবসায়ী মেহেদী হাসান জানান, এখানে উৎপাদিত সকল ধরনের সবজি অল্প দামে কিনে নিয়ে বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করি। নৌকা অথবা ট্রলারে করে বিভিন্ন বাজারে নিয়ে যাওয়ায় যাতায়াত খরচ কম। তাই ব্যবসার পরিমাণ বেশি থাকে।

এলাকার একাধিক চাষিরা বলছেন, এ ধরনের চাষ বেশ ব্যয়বহুল। তবে স্থানীয় সবজির চাহিদা মেটাতে এ ধরনের চাষ বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তাই এ চাষে সরকারি প্রণোদনারও দাবি জানান তারা। চাষিরা আরও বলেন, চাষাবাদ করে আমরা কোনো সরকারি সহযোগিতা পাচ্ছি না। ফলে বিভিন্ন ব্যক্তি ও এনজিওর কাছ থেকে চড়া সুদে লোন নিয়ে আমরা এই চাষাবাদ টিকিয়ে রাখছি। আমাদের (চাষিদের) স্বল্প সুদে ঋণ দেয়ার দাবি জানাই সরকারের কাছে।

বলদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. সাইদুর রহমান সাইদ জানান, বেডে উৎপাদিত সবজি সম্পূর্ণ বিষমুক্ত। তা ছাড়া খরচও তুলনামূলক কম। ফলে কৃষক বেশি দামে বিক্রি করে লাভবান হতে পারেন। ভাসমান বেডে সবজি চাষে কীটনাশক ও রাসায়নিক সার লাগে না। ফলে সবজির গুণগত মান ও স্বাদ অক্ষুণ্ন থাকে। এ ব্যাপারে কৃষকদের মাঝে স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

এ বিষয় নেছারাবাদ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা চপল কৃষ্ণ নাথ জানান, নেছারাবাদ উপজেলার বিলাঞ্চলে ভাসমান বেডে কৃষি সবজি উৎপাদনের সুনাম দেশ বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ভাসমান বেডে সবজি উৎপাদনকারী কৃষকদের আমার দপ্তর থেকে প্রশিক্ষণসহ প্রশিক্ষণের পাশাপাশি তাদের বিভিন্ন প্রজাতির সবজির বীজ বিতরণ করা হয়। এ ছাড়াও কৃষকদের সুযোগ সুবিধা আদায়ে উপজেলা প্রশাসন সর্বদা খেয়াল রাখছে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

পাক সীমান্তে ট্যাঙ্ক ও ভারী অস্ত্র মোতায়েন আফগানিস্তানের

তিন মন্ত্রণালয়ের ৩ সচিবকে বদলি

নতুন ধর্ম সচিব কামাল উদ্দিন

খুলনায় শিশু হত্যায় জড়িত ফয়সালের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ

শিশু মিমের চিকিৎসার দায়িত্ব নিলেন শিমুল বিশ্বাস

পুয়ের্তো রিকো ম্যাচের আগে দুঃসংবাদ পেল আর্জেন্টিনা

পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনসহ ৫ দাবিতে ঢাকার ডিসিকে জামায়াতসহ ৭ দলের স্মারকলিপি

ট্রুডোর সঙ্গে প্রমোদতরীতে ঘনিষ্ঠ কেটি পেরি

রাবিতে ফারুক হত্যা মামলার সব আসামি বেকসুর খালাস

সড়ক দুর্ঘটনায় আহত বাবাকে বাঁচাতে চান হাবিপ্রবির সালমা

১০

রাতের অন্ধকারে ভোট চাই না : সিইসি

১১

খাওয়ার পর বসে থাকার অভ্যাস ধূমপানের মতোই বিপজ্জনক

১২

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে লাইভ চলাকালে ফেসবুক পেজে সাইবার হামলা

১৩

পাকিস্তানের ৫৮ সেনা নিহত, দাবি আফগানিস্তানের

১৪

‘পরোয়ানা জারি হওয়া সেনা কর্মকর্তাদের বিচারের ক্ষমতা রয়েছে ট্রাইব্যুনালের’

১৫

দু-তিন দিন ধরে ফ্ল্যাট বন্ধ, পুলিশ এসে উদ্ধার করল পাঁচটি মৃতদেহ

১৬

‘বৈষম্য আর আধিপত্যবাদের আগ্রাসন থেকে সেফ এক্সিট দরকার’

১৭

২০২৭ বিশ্বকাপ সরাসরি খেলতে বাংলাদেশের সামনে যে সমীকরণ

১৮

আপনার হোয়াটসঅ্যাপ অন্য কেউ ব্যবহার করছে না তো!

১৯

আন্দোলনরত শিক্ষকদের কর্মসূচিতে পুলিশের বাধা, সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ

২০
X