ঈশ্বরগঞ্জ (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি
প্রকাশ : ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯:৩২ পিএম
আপডেট : ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:১৬ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

বত্রিশ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে মেলে কামালের দগ্ধ মরদেহ

বত্রিশ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে অগ্নিদগ্ধ হন কামাল হোসেন। ছবি : সংগৃহীত
বত্রিশ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে অগ্নিদগ্ধ হন কামাল হোসেন। ছবি : সংগৃহীত

আন্দোলনের উদ্দেশ্যে গত ৫ আগস্ট বাসা থেকে বের হন কামাল হোসেন। পরদিন সকালে তার দগ্ধ মরদেহ মেলে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পোড়া বাড়ির বাগানে। পরনে থাকা গেঞ্জির পেছনে কামালের নাম লেখা ছিল। সঙ্গে মোবাইল ফোনসহ সবই ঠিক ছিল। পরে তার মোবাইল ফোন থেকে সিম বের করে স্থানীয় একজন পরিবারকে ফোন করে মৃত্যুর খবর পৌঁছে দেন।

এ ঘটনায় কামালের শরীর এমনভাবে দগ্ধ হয়েছিল, তার পরনের প্যান্টও খোলা যায়নি। পরনে থাকা প্যান্টসহ দাফন করা হয় মরদেহ।

নিহত মো. কামাল হোসেনের বাড়ি ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার রাজিবপুর ইউনিয়নের খুলিয়ারচর গ্রামে। ওই গ্রামের কৃষক হাশিম উদ্দিনের ছেলে তিনি। ছয় ভাইয়ের মধ্যে তৃতীয় ছিলেন কামাল হোসেন। তার মায়ের নামে মজিদা খাতুন। দুই বছর আগে কামাল বিয়ে করেছিলেন নোয়াখালীর শারমিন আক্তারকে। তাদের সংসারে কোনো সন্তান নেই। লালবাগ কবরস্থান এলাকায় স্ত্রীর পরিবারের সঙ্গে বসবাস করতেন কামাল হোসেন। সেখানে একটি হোটেলে রান্নার কাজ করতেন, আবার কখনো রিকশাও চালাতেন।

নিহতের বড় ভাই লিটন মিয়া বলেন, গত ৬ আগস্ট সকাল ১০টার দিকে আমরা খবর পাই কামালের। তার মোবাইল ফোন থেকে নম্বর নিয়ে একজন কল করে জানান বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে কামালের লাশ পড়ে আছে। পরে আমরা গিয়ে ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির বাগান থেকে ছোট ভাইয়ের লাশ পাই। লাশটা যখন পাই, তখন পুড়ে সিদ্ধ অবস্থায় ছিল। শরীর পুড়ে কালো হয়ে গেছিল। মুখও কিছুটা নষ্ট হয়ে যায়। চেহারা দেখে চেনার কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু পরনের গেঞ্জির পেছনে নাম লেখা ছিল। তার গেঞ্জি, প্যান্ট ও মোবাইল দেখে আমরা চিনতে পারি।

তিনি আরও বলেন, আমরা সেখানে গিয়ে শুধু লাশ পেয়েছি। সে সময় সেখানের লোকজনকে কীভাবে মারা গেছে জিজ্ঞাস করলেও তা কেউ বলতে পারিনি। পরে সেখান থেকে সরাসরি লাশ বাড়িতে নিয়ে আসি। কোনো ময়নাতদন্তও হয়নি। ধারণা করছি, আমার ভাইকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। কারা মারতে পারে সঠিক ধারণা করতে পারছি না। লিটন মিয়া বলেন, আন্দোলনে যোগ দিতে ৫ আগস্ট বাসা থেকে বের হয়ে আমার ভাইয়ের মৃত্যু হয়।

পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, সংসারে অভাবের কারণে কামাল পড়ালেখা করতে না পারায় ১৫ বছর ধরে ঢাকায় হোটেলে রান্নার কাজ করছিলেন। নিজে পড়ালেখা না করতে পারলেও ছোট ভাই হাদিস মিয়াকে নরসিংদীতে মাদ্রাসায় পড়াচ্ছিলেন। সেখানে একটি মাদ্রাসায় কিতাব বিভাগে পড়লেও কামাল মারা যাওয়ায় পড়ার খরচ দিতে পারবে না বলে তাকে বাড়িতে নিয়ে এসেছেন বাবা। ছোট বোন আলিফা খাতুনকেও স্থানীয় একটি মহিলা মাদ্রাসায় পড়াচ্ছিলেন খরচ দিয়ে।

গত ৫ আগস্ট আন্দোলনে যোগ দিতে সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে যান কামাল হোসেন। সে সময় বাধা দিয়েছিলেন স্ত্রী শারমিন আক্তার ও শাশুড়ি। কিন্তু বাধা মানেননি। স্ত্রীকে বলে যান, আমি আন্দোলনে যাচ্ছি। আমি যদি মরে যাই, তাহলে কোনো দাবি রাখবে না। তখন শাশুড়ি নিষেধ করলে তিনি (কামাল) প্রত্যুত্তরে জানিয়েছিলেন, যেতে না দিলে শ্বশুরকেসহ নিয়ে যাবে। কিন্তু আন্দোলনে গেলেও সেদিন আর বাসায় ফেরেনি কামাল। তার মোবাইল ফোনও বন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল। পরে গত ৬ আগস্ট সন্ধ্যায় কাঁচামাটিয়া নদীর পাশে খুলিয়ারচর জামে মসজিদের মাঠের কোণে দাফন করা হয়েছে কামালের লাশ।

বুধবার (১১ সেপ্টেম্বর) তার কবরের পাশে গিয়ে পাওয়া যায় বাবা হাশিম উদ্দিনকে। বৃষ্টির পানিতে কবরের মাটি দেবে যাওয়া নিয়ে চিন্তিত তিনি। হাশিম উদ্দিন বলেন, আমার পোলার শরীরে কোনো আঘাত ছিল না। শুধু শরীর সিদ্ধ হয়ে যায়। সঙ্গে থাকা জিনিসপত্র, টাকা সবই ঠিক ছিল। শরীর এমনভাবে দগ্ধ হয়েছিল, শরীর থেকে প্যান্ট খুলতে গেলে মাংস উঠে আসতে শুরু করে। পরে প্যান্টসহ মাটি দেওয়া হয় তাকে।

মানুষের জমিতে দিনমজুরি করতেন হাশিম উদ্দিন। আহাজারি করে তিনি বলেন, ‘আমারে কইতো কাজকাম ছাইড়্যা ঠিকমতো নামাজ পড়বা, মসজিদে যাইবা, চিল্লায় যাইবা। আমার ছোট ভাইবোনদের মাদ্রাসায় পড়ার খরচ ও সংসারের সব খরচ আমি দিমু। কিন্তু আমার সেই ছেলেই চইল্যা গেল। ছেলের কথা মনে অইলে জীবনডা বাইরইয়্যা যায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমার ছেলে বাড়িতে লাশ অইয়া আইছে। আমি কান্দ লাইয়া নিয়ে মাডি দিছি। ছেলেরা আমার লাশ কান্দে লাইব; কিন্তু ছেলের লাশ আমার কান্দে লওন লাগছে। ছেলেডা আমার খুব দেখাশোনা করত। কিন্তু এই ছেলেডাই গেছে গা। বাংলাদেশ সরকারের কাছে এর বিচার চাই।’

ছেলের কথা মনে হলেই নিহতের মা মজিদা খাতুন আহাজারি করেন। তিনি বলেন, ‘আমার বাবার শরীলডা হিদ্দ অইয়া গেছিল, ঠোডের চামড়াডা গেছিল না। মুখটা কালো অইয়া গেছিল। আমার বাবা কিবায় পুইড়্যা গেছে কইতে পারি না। আমার বাবা তো অহন ফোন করে না। যেদিন মারা যায়, তার আগের দিনও ফোন করছিল। কইছিল টেহা পাডাইতে না পারলে, বাড়িতে আয়া পড়ব। এই পোলাডা আমার কইলজার গোরদা আছিল। সংসার হেই দেখশন করত। হেই পোলাই আমার শেষ অইয়া গেল।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বরইতলা নদীর ‘বাঁধ’ এখন মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতর

ইস্পাত খাতে বিশেষ তহবিল চান ব্যবসায়ীরা

বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধিতে আগ্রহী পাকিস্তান

উপকূলজুড়ে টানা বৃষ্টিপাত, জনজীবনে দুর্ভোগ

উমামা-সাদীর নেতৃত্বে ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য’ প্যানেল ঘোষণা

ডেঙ্গুতে আরও ৫ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৩১১ জন

ডাকসু নির্বাচন / ঢাবি শিক্ষার্থীদের প্রতি মির্যা গালিবের আহ্বান

বাংলাদেশি সন্দেহে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মারধর

মৃত ব্যক্তির জন্য বিলাপ করে কান্না করলে কি কবরে আজাব হয়?

কবিতার ছন্দে সুনেহরা-আরশের মিষ্টি কথোপকথন

১০

রাগবির ধাঁচে ক্রিকেটারদের এবার নেওয়া হবে ‘ব্রঙ্কো’ টেস্ট!

১১

‘ডাকসুতে দাঁড়াইছে সবাই, বসে আছে একজনই’

১২

সাতক্ষীরা-৪ আসনে কালীগঞ্জ ও শ্যামনগর রাখার দাবিতে বিএনপির স্মারকলিপি

১৩

জকসুর দাবিতে জবিতে শিক্ষার্থীদের অবস্থান কর্মসূচি

১৪

স্ত্রীকে নোরা ফাতেহির মতো বানাতে না খাইয়ে রেখে ব্যায়াম করান স্বামী

১৫

‘ভুল’ আংটি দিয়ে প্রেমিকাকে ‘প্রপোজ’ করেন রোনালদো!

১৬

ঢাকা ও সিটি কলেজ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ফের সংঘর্ষ, স্থায়ী সমাধান চান রমনার ডিসি

১৭

বসুন্ধরা শপিংমলে ক্লাব হাউসের ফেস্টিভ কালেকশন উন্মোচন

১৮

কালো তালিকাভুক্ত হলেন ৭১ শিক্ষক

১৯

দায়িত্ব নিয়েই হুঁশিয়ারি দিলেন সারোয়ার আলম

২০
X