বর্ষা মানেই পাহাড়ধসের শঙ্কা। কিন্তু এরপরও থামেনি পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস। রাঙামাটিতে ২০১৭ সালের ১৩ জুন পাহাড়ধসে ১২০ জন মারা যাওয়ার পরও ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বেড়েছে বসতি। ওই সময় তদন্ত কমিটির দেওয়া সুপারিশমালারও হয়নি বাস্তবায়ন।
প্রশাসনের তথ্যমতে, শহরে ৩১টি পয়েন্টকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসতি স্থাপন বন্ধে সমন্বয়ের কথা বলছেন সুশীল সমাজ। আর ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসতি স্থাপন বন্ধে সবার সহযোগিতা চেয়েছেন জেলা প্রশাসক।
ঘটনার প্রেক্ষাপট
২০১৭ সালের ১২ জুন সন্ধ্যা থেকে শুরু হয় বৃষ্টি। মধ্যরাত থেকে শুরু হয় বজ্রসহ ভারী বৃষ্টি। রাত তিনটার পর থেকে বিভিন্ন স্থানে পাহাড়ধসের খবর শোনা যায়। আর ১৩ জুন ভোরের আলো ফুটতেই শহরের ভেদভেদী, মোনতলা, রাঙ্গাপানি, শিমুলতলি, মুসলিম পাড়া ও লোকনাথ মন্দির এলাকা, সদর উপজেলার মগবান ও সাপছড়ি ইউনিয়নসহ পাঁচটি উপজেলার বিভিন্ন স্থানে পাহাড়ধসে মাটি চাপা পড়ে হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির খবর আসতে থাকে। বৃষ্টির মধ্যেই শুরু হয় হাসপাতালে লাশের মিছিল।
এতে রাঙামাটি জেলায় পাঁচ সেনা সদস্যসহ প্রাণ যায় ১২০ জনের। রাঙামাটি-চট্টগ্রাম, রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি-বান্দরবান সড়কের অন্তত ১৪৫টি জায়গায় পাহাড়ধসে মাটি পড়ায় ও সড়ক ভেঙে যাওয়ায় রাঙামাটির সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায় সারা দেশের সড়ক যোগাযোগ। তিন দিন বিচ্ছিন্ন ছিল বিদ্যুৎ সংযোগ। যার ৮ দিন পর স্বল্প পরিসরে চালু হয় সড়ক যোগাযোগ। ঘরবাড়ি, স্বজন হারানো দুই হাজারের বেশি মানুষ ঠাঁই নেয় আশ্রয়কেন্দ্রে। বছর ঘুরে দিনটি ফিরে এলে রাঙামাটিবাসীর মনে ভেসে ওঠে সেই ভয়াল স্মৃতি।
সেই ভয়াল স্মৃতি ধারণ করেও পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বেড়েছে বসতি স্থাপন। পাহাড়ের দুইপাশ জুড়েই ঘরবাড়ি। কোথাও কোথায়ও তৈরি হয়েছে ইমারত। এই চিত্র শহরের শিমুলতলী, রূপনগর, সনাতন পাড়া, যুব উন্নয়ন ও রাঙাপানি এলাকার। স্থানীয়দের তথ্যমতে, ২০১৭ সালের পরে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় আরও অন্তত ৫০০ নতুন পরিবার বসতি স্থাপন করেছে। অথচ ওই বছরের ১৩ জুন ভয়াবহ পাহাড়ধসে ১২০ জনের প্রাণহানির পরও ২০১৮ সালে ১২ জুন নানিয়াচরে একই কারণে ১১ জনের মৃত্যু হয় রাঙামাটিতে।
সব মিলিয়ে ২০১৭ সালের পর অন্তত আরও ১৫ জনের মৃত্যুর কারণ এই পাহাড়ধস। ২০১৭ সালে পাহাড়ধসের পর তদন্ত কমিটি পাহাড় কাটা, পাহাড়ের টিলায় বসতি স্থাপন বন্ধ, পরিবেশ বান্ধব বৃক্ষরোপনের মতো বেশ কিছু সুপারিশ করে। সেই ঘটনার ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও সুপারিশমালার বাস্তবায়ন আলোর মুখ দেখেনি। বরং ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় নাগরিক সুবিধা বেড়ে যাওয়ায় মৃত্যু জেনেও বসতি নির্মাণে আগ্রহ বেড়েছে স্বল্প আয়ের মানুষের। শত ঝুঁকি জেনেও নিজেদের বসতবাড়ি ছাড়তে রাজি নয় বসবাসকারীরা।
কী বলছেন পাহাড়ে বসবাসকারীরা
রাঙামাটি শিমুলতলী এলাকারবাসীন্দা আমেনা আক্তার জানান, ‘আমি এখানে জায়গা কিনে বসবাস করছি। ঝুঁকি জানলে কী হবে, আমারতো অন্য জায়গা নাই যে আমি ওখানে যাব। যার কারণে এখানেই বসবাস করি। সৃষ্টিকর্তাই ভরসা।’
ফাতেমা আক্তার বলেন, ‘আমি দুই বছর হলো জায়গা কিনেছি। ছয় মাস হলো ঘর তৈরি করে এখানে এসেছি। এখনোতো কোনো সমস্যা হয় নাই। বর্ষা এলে বলতে পারব কী হয়।’
কী বলছেন সংশ্লিষ্টরা
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর রাঙামাটি জেলার সাধারণ সম্পাদক এম জিসান বখতিয়ার বলেন, ‘২০১৭ সালের পর রাঙামাটিতে পাহাড়ধসের ঝুঁকি ও ক্ষয়ক্ষতি কমাতে বেশ কিছু সুপারিশমালা দেওয়া হয়। সেসব সুপারিশমালার বাস্তবায়ন আমরা দেখতে পাচ্ছি না। অবিলম্বে সেসব সুপারিশমালা জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসন সমন্বয়ের মাধ্যমে বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে আশা করছি, না হয় আবারও যে কোনো বর্ষায় ২০১৭ সালের চিত্র আমাদের দেখতে হতে পারে।’
রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘এই বিষয়ে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। এটা আমাদের একার পক্ষে সম্ভব না। আমরা দুর্যোগের সময় ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসবাস করা মানুষদের যখন বলি, সেখান থেকে সরে আসতে, তখন তারা সরেন না। তাদের অনেকেরই পরিবার ২০১৭ সালে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
‘তারা সেটাকেও কেন জানি ভুলে যাচ্ছে। সুপারিশমালা বাস্তবায়নে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। সবাই এগিয়ে এলে এটা বাস্তবায়ন সম্ভব।’
২০১৭ সালের জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, জেলায় ৪ হাজার পরিবারের প্রায় ১৫ হাজার লোক পাহাড়ে ঝুঁকিতে বসবাস করছে।
মন্তব্য করুন