সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জের প্রত্যন্ত গ্রামে নির্মাণাধীন ভবনের নিচে তৈরি গুপ্তঘরে শিল্পী খাতুন নামে এক নারী এবং আব্দুল জুব্বার নামে এক বৃদ্ধের বন্দি থাকার রহস্য দুদিনেও উদ্ঘাটন হয়নি। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার প্রধান আসামি গ্রাম্য ডাক্তার নাজমুল ইসলাম আরাফাতের দুদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
রোববার (৪ মে) দুপুরে বৃদ্ধ আব্দুল জুব্বারকে বন্দি রাখার ঘটনায় প্রধান আসামি আরাফাতকে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট-১ (রায়গঞ্জ আমলি আদালত) আদালতে হাজির করে ৭ দিনের রিমান্ড আবেদন করে পুলিশ। শুনানি শেষে বিচারক সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. আলমগীর হোসেন ২ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
গ্রেপ্তার নাজমুল ইসলাম আরাফাত পশ্চিম লক্ষীকোলা গ্রামের মৃত রেজাউল করিম তালুকদারের ছেলে।
সিরাজগঞ্জ কোর্ট পরিদর্শক মো. আসলাম হোসেন এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, নাজমুল ইসলাম আরাফাতকে একটি মামলায় দুদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। অপর একটি মামলায় শ্যোন এরেস্টের আবেদন করা হয়েছে।
এর আগে, গত শুক্রবার (২ মে) ভোরে রায়গঞ্জ উপজেলার চান্দাইকোনা ইউনিয়নের প্রত্যন্ত সোনারাম গ্রামে দিনমজুর জহুরুল ইসলামের বাড়িতে নির্মাণাধীন ভবনের নিচে গুপ্তঘর থেকে মাটি খুঁড়ে সুরঙ্গ পথ তৈরি করে বেড়িয়ে আসেন লক্ষিবিষ্ণুপ্রসাদ গ্রামের মুনসুর আলীর স্ত্রী শিল্পী খাতুন (৩৮) ও পূর্ব পাইকড়া গ্রামের মৃত রুস্তম শেখের ছেলে আব্দুল জুব্বার (৭৫)। খবরটা ছড়িয়ে পড়লে বিক্ষুব্ধ জনতা জহুরুলের বাড়িঘর ও গুপ্তঘর ভাঙচুর এবং আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। একইদিনে পশ্চিম লক্ষীকোলা গ্রামে অভিযুক্ত নাজমুল ইসলাম আরাফাতের ঘরবাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। পশ্চিম লক্ষীকোলা গ্রামের আরাফাতের সেচপাম্প ঘরে আরও একটি গুপ্তঘরের সন্ধান পায় স্থানীয়রা।
সরেজমিনে সোনারাম গ্রামে জহুরুল ইসলামের বাড়িতে গিয়ে নির্মাণাধীন ভবনের নিচে গুপ্তঘরটি দেখতে পাওয়া যায়। ওই গুপ্তঘরটি ভাঙচুর করায় সেটা বেড়িয়ে এসেছে। ঘরটির প্রতিটি কক্ষ এক একটি কবরের সমান। সামনে রয়েছে করিডোর, প্রতিটি কক্ষে প্রবেশের জন্য ছোট ছোট গেট রয়েছে। ঘরের পূর্ব কোনায় একটি মাটির সুরঙ্গ দেখতে পাওয়া যায়, যে সুরঙ্গ দিয়ে ওই নারী ও বৃদ্ধ পালিয়ে গেছে বলে দাবি করেছেন।
চান্দাইকোনা ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের মেম্বার জহুরুল ইসলাম বলেন, সোনারাম গ্রামের জহুরুল একজন দরিদ্র দিনমজুর। তার ছেলে সুমন হোটেলে কাজ করে। কিছুদিন আগে একটি দুর্ঘটনায় জহুরুলের পা ভেঙে গেলে গ্রামবাসী চাঁদা তুলে চিকিৎসা করায়। হঠাৎ করে তার বাড়িতে ভবন নির্মাণের বিষয়টি নিয়ে সবার মনে সন্দেহ ছিল। আরাফাতের টাকাতেই এই ভবনটি নির্মাণ হয়েছে বলে গ্রামবাসীর ধারণা।
তিনি বলেন, আন্ডারগ্রাউন্ডে যেভাবে ছোট ছোট কক্ষ নির্মাণ করা হয়েছে, তাতে ধারণা করা যায়, সেটি একটি টর্চার সেল। মানুষ ধরে এনে সেখানে নির্যাতন করা হতো।
স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলেন, আরাফাতের বড় ভাই ঢাকায় ডাক্তারি করে। তিনি নাকি কিডনি ও বাল্ব তার ভাইকে সাপ্লাই দেন।
এদিকে সোনারাম গ্রাম থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার দূরে পশ্চিম লক্ষীকোলা নাজমুল ইসলাম আরাফাতের গ্রামের বাড়িতে গেলে তার ইরির প্রজেক্টে আরও একটি গুপ্তঘরের সন্ধান পাওয়া যায়। ভয়ংকরভাবে নির্মিত এই গুপ্তঘরেও রয়েছে ৩টি কক্ষ। ভেতরের কোন শব্দ বাইরে যাতে না আসে সে জন্য ঘরের বাইরে দুই স্তরের দেয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। তবে বোঝা যায় ওই কক্ষগুলো সদ্য নির্মিত। ওই প্রজেক্টে এমন গুপ্তঘর তৈরির বিষয়টি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেননি বলে গ্রামবাসীরা দাবি করেন।
এলাকাবাসী বলেন, আরাফাত কখনো সাংবাদিক, কখনো সমন্বয়কের পরিচয়ে দাপিয়ে বেড়ান। তিনি গ্রাম্য ডাক্তার হলেও তার কোনো সার্টিফিকেট নেই। ভাই নাঈম আহমেদ বাধন সাভারে এনাম মেডিকেলের ডাক্তার। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে তৎকালীন ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামের দাপট দেখিয়ে এলাকায় সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাতেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। আরাফাতের বিরুদ্ধে মামলাবাজি, চুরি, ব্ল্যাকমেইলসহ বিভিন্ন অভিযোগ থাকলেও গুপ্তঘরে মানুষকে আটকে রাখে তাদের সাথে কী করা হতো সে বিষয়টি সবারই অজানা।
জুয়েল রানা নামে একজন বলেন, আরাফাত মানুষকে অপহরণ করে এনে এই গোপন ঘরে আটকে রাখে। চক্রটি কিডনি পাচারের সঙ্গেও জড়িত থাকতে পারেন বলে দাবি করেন তিনি।
ভুক্তভোগী শিল্পী খাতুন ও আব্দুল জুব্বারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৬ মাস আগে তাদের কৌশলে তুলে নিয়ে যায় আরাফাত। এরপর হাত-পা বেঁধে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ৫ মাস ২৫ দিন আগে জুব্বারকে এবং ৪ মাস আগে শিল্পী খাতুনকে গোপন ঘরটিতে রাখে। আরাফাত তাদেরকে মেরে কিডনিসহ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রির কথাও বলেছিল। গোপন ঘরে তাদের দিনে একবার খেতে দেওয়া হতো। গোসলেরও কোনো ব্যবস্থা ছিল না। প্রায় ৬ মাস পর মুক্তি পেয়ে তারা গোসল দিয়েছেন। অন্ধকার কক্ষে ছিল না আলোর ব্যবস্থা। আরাফাতের রেখে যাওয়া একটি কেচি দিয়ে ৫ দিন ধরে মাটি খুঁড়ে সুরঙ্গ পথ তৈরি করে বেরিয়ে আসেন তারা।
রায়গঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আসাদুজ্জামান জানান, শিল্পী খাতুনের স্বামী মনসুর আলী ও আব্দুল জুব্বারের ছেলে শফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে আরাফাতকে প্রধান আসামি করে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করেন। এসব মামলায় ২৫ জনকে আসামি করা হয়। প্রধান আসামি আরাফাতকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই মূল রহস্য বেরিয়ে আসবে।
তিনি বলেন, দুটি গ্রামে আন্ডারগ্রাউন্ড কক্ষ পাওয়া গেছে। প্রতিটি কক্ষ মাত্র ৪ ফুট উঁচু, দৈর্ঘ্য ৯ ফুট এবং প্রস্থ ৪ ফুট।
সিরাজগঞ্জ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম এন্ড অপস) মো. জিয়াউর রহমান বলেন, প্রধান আসামি ধরা পড়েছে, তাকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদে যদি কোন কিছু পাওয়া যায়। আর আমাদের তদন্ত চলছে। তদন্তে যেটা আসে দেখা যাক।
আর্কাইভ 
| ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫ 
