সারা দেশের আদালতগুলোতে সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ বিধির সংশোধনের কাজ চলমান রয়েছে। ওই বিধি সংশোধনের মাধ্যমে লোকবল নিয়োগের ক্ষমতা বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশনের হাতে নেওয়া হচ্ছে। অধস্তন আদালতে জনবল নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতি-অনিয়মের কারণে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এই পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে। এ কারণে গত ১৩ মার্চ সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন অধস্তন আদালতের শুন্য পদ পূরণ সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপনের কার্যকারিতাও শিথিল করেছে।
এতকিছুর পরও পাবনার জেলা জজ আদালতে তড়িঘড়ি করে ১৮টি শুন্য পদে লোকবল নিয়োগ করা হচ্ছে। আগামী ৯ মে এই নিয়োগের লিখিত পরীক্ষা হওয়ার কথা রয়েছে। চলমান এই নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ইতোমধ্যে এ নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতি-অনিয়ম হতে যাচ্ছে বলে মন্ত্রণালয়ের কাছে লিখিত অভিযোগ এসেছে। জেলা জজ ও অধস্তন আদালতসমূহ এবং বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতসমূহ (কর্মকর্তা ও কর্মচারী) নিয়োগ বিধিমালা, ১৯৮৯ এবং জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসি ও মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেসির আদালতসমূহ (সহায়ক কর্মকর্তা ও কর্মচারী) নিয়োগ বিধিমালা, ২০০৮ অনুযায়ী লোকবল নিয়োগ করা হয়। ওই নিয়োগ বিধি দুটির সংশোধনের কাজ চলমান। গত ৭ এপ্রিল এই বিধি সংশোধনের জন্য তৈরি করা খসড়া অনুমোদনের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কাছে পাঠানো হয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ‘নিয়োগবিধি পরীক্ষণ-সংক্রান্ত উপকমিটি’ এটি যাচাই-বাছাই করে অনুমোদন দেবে। জনপ্রশাসনের অনুমোদন সম্পন্ন হলেই আইন মন্ত্রণালয় থেকে সংশোধিত নিয়োগবিধির প্রজ্ঞাপন জারি হবে। এর মধ্য দিয়ে নিয়োগের ক্ষমতা চলে যাবে বাংলাদেশ জুড়িসিয়াল সার্ভিস কমিশনের হাতে।
জানা গেছে, প্রচলিত দুটি নিয়োগ বিধিমালার সংশোধনীতেই বাছাইকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনকে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশেষ বিধান করে এই খসড়া বিধিমালায় বলা হয়েছে, বিধিমালার এই সংশোধনী কার্যকর হওয়ার তারিখে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের অধীনে চলমান কোনো সরাসরি নিয়োগের কার্যক্রমে লিখিত পরীক্ষা গ্রহণ সম্পন্ন না হলে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ বৈধ প্রার্থীদের আবেদনসমূহ, তদ্সংযুক্ত কাগজাদি (যদি থাকে) ও নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বিধিমালার এই সংশোধনী কার্যকর হওয়ার সাত কার্যদিবসের মধ্যে বাছাইকারী কর্তৃপক্ষের কাছে প্রেরণ করবে। বাছাইকারী কর্তৃপক্ষ বর্ণিত আবেদন, তদ্সংযুক্ত কাগজাদি (যদি থাকে) ও নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রাপ্তির পর তার ভিত্তিতে বাছাইসংক্রান্ত কার্যক্রম গ্রহণ করবে এবং এ ক্ষেত্রে নতুন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ও আবেদন আহ্বানের প্রয়োজন হবে না। তবে বিধিমালার এই সংশোধনী কার্যকর হওয়ার তারিখে কোনো নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের অধীনে সরাসরি নিয়োগের কার্যক্রমে লিখিত পরীক্ষা সম্পন্ন হয়ে থাকলে এবং তৎপরবর্তী কোনো ধাপ অনিষ্পন্ন থাকলে ওই পদের নিয়োগ ও বাছাই কার্যক্রম এমনভাবে সম্পন্ন করতে হবে যেন বিধিমালার এই সংশোধনী জারি হয়নি।
আইন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খুব দ্রুতই এই নিয়োগ বিধি সংশোধনীর গেজেট জারি হবে। আর গেজেট জারি হওয়ার পূর্বেই লিখিত পরীক্ষা শেষ করা হলে পুরো নিয়োগ পরীক্ষা পাবনা জেলা জজ আদালত কর্তৃপক্ষ শেষ করতে পারবেন। সেজন্য তড়িঘড়ি করে লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে।
জানা গেছে, সুপ্রিমকোর্ট থেকে গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর সারাদেশের অধস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনালসমূহের সহায়ক কর্মচারীর শূন্য পদসমূহ যথাযথ বিধি-বিধান অনুসরণপূর্বক নিয়োগ/পদোন্নতির মাধ্যমে তিন মাসের মধ্যে পূরণ করে অবহিত করার জন্য অধস্তন আদালতগুলোকে নির্দেশ প্রদান করা হয়। কিন্তু নিয়োগ বিধির এই সংশোধনী চলমান থাকায় গত ১৩ মার্চ সুপ্রিমকোর্ট ফের একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে পূর্বের বিজ্ঞপ্তির কার্যকারিতা শিথিল করেন।
জানতে চাওয়া হলে সুপ্রিমকোর্টের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, নিয়োগ বিধি দুটির সংশোধন চলমান রয়েছে। জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে লোকবল নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এ কারণে শুন্য পদ পূরণ করতে পূর্বের বিজ্ঞপ্তির কার্যকারিতা গত ১৩ মার্চ শিথিল করা হয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এতে করে নিয়োগ কার্যক্রম চলমান রাখতে কোন বাধা নেই। তবে এর সঙ্গে নৈতিকতার প্রশ্ন জড়িত।
এদিকে মন্ত্রণালয়ের কাছে এই নিয়োগ নিয়ে লিখিত অভিযোগ এসেছে। অভিযোগে বলা হয়েছে, পাবনার বর্তমান জেলা জজ, গত বছরের ২৮ অক্টোবর রাজশাহী থেকে পাবনায় জেলা জজ হিসাবে যোগদান করেন। তার গ্রামের বাড়ি বগুড়ায় এবং শ্বশুরবাড়ি রাজশাহী শহরে। জেলা জজের স্ত্রী রাজশাহীতে চাকরি করেন। উক্ত জেলা জজ রাজশাহীতে দীর্ঘদিন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পদে চাকরি করেন। অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, জেলা জজ নিয়োগের জন্য যে কমিটি তৈরি করেছেন, তার চেয়ারম্যানের বাড়ি নওগাঁ এবং তারও শ্বশুরবাড়ি রাজশাহী। কমিটির সদস্য ল্যান্ড সার্ভে, ট্রাইব্যুনালের জজের বাড়ি রাজশাহী এবং শ্বশুরবাড়িও রাজশাহী। অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, নিয়োগ বাণিজ্য নিশ্চিত করতে জেলা জজ তার পূর্ব পরিচিত প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে পাবনা বদলি করে নিয়ে যান। ওই প্রশাসনিক কর্মকর্তার বাড়ি পাবনার ইশ্বরদী উপজেলায় এবং জেলা জজের সঙ্গে রাজশাহীতে কর্মরত ছিলেন। অভিযোগে বলা হয়েছে, মৌলভীবাজারে চাকরি করার সময় জেলা জজ একজন পিয়নকে নিয়োগ দেন। তাকেও বদলি করে পাবনায় নিয়ে এসেছেন। এই পিয়ন ইতোমধ্যে নিয়োগের জন্য তিন জনের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন।
অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, পাবনা জজ কোর্টের জারীকারক জেলা জজের পিয়ন হিসাবে রাজশাহীতে দীর্ঘদিন চাকরি করেছেন। তিনিও চাকরি দেওয়ার নাম করে দুজনের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন। এছাড়া আরও বেশ কয়েকজন কর্মচারীর নাম উল্লেখ করে অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, তারাও চাকরি দেবেন বলে ইতোমধ্যে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন।
এসব অভিযোগের ব্যাপারে বক্তব্য নেওয়ার জন্য পাবনার জেলা ও দায়রা জজ মো. এনায়েত কবির সরকারকে ফোন করা হয়। কিন্তু তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এছাড়া হোয়াটসঅ্যাপে বক্তব্য চেয়ে মেসেজ দেওয়া হলেও তিনি সাড়া দেননি।
তবে নিয়োগ কমিটির চেয়ারম্যান মো. মাহমুদ হাসান (অতিরিক্ত জেলা জজ-২) কালবেলাকে বলেন, এ বিষয়ে আমার বক্তব্য দেওয়ার তেমন সুযোগ নেই। তারপরও এই প্রথম এমন অভিযোগ শুনলাম।
তিনি আরও বলেন, বিধিনিষেধ না থাকলে চলতে সমস্যা নেই। এখানে ৬০-৬২ জন কর্মচারীর অভাব। সেজন্য কর্তৃপক্ষ তার প্রয়োজন মেটানোর উদ্যোগ নিয়েছেন। আমাকে একটি দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিয়েছেন। উনার নির্দেশ মতো কাজ করছি। তারপরও আশঙ্কায় আছি, যে কোন সময় এটা থেকে যেতে পারে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ চাইলে এই নিয়োগ বন্ধ করে দিতে পারেন।
দুর্নীতির অভিযোগের ব্যাপারে তিনি বলেন, অভিযোগের সত্যতা থাকলে তা যাচাই-বাছাই করার অথরিটি তা দেখতে পারেন।
মন্তব্য করুন