তীব্র তাপপ্রবাহে পুড়ছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের খুলনাসহ আশপাশের জনপদ। রোদের তীব্র তাপে তেঁতে উঠছে প্রকৃতি। সকালের সূর্য উদয় হচ্ছে আগুনের হল্কা নিয়ে। ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকা এই তাপপ্রবাহে পুড়ছে সাধারণ মানুষের জনজীবন। এ অঞ্চলে প্রতি বছর গড়ে ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস হারে বাড়ছে তাপমাত্রা। জলবায়ু পরিবর্তনের এ গতি অব্যাহত থাকলে সামনে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে খুলনাবাসী- এমনই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে শুধু খুলনাই নয়, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরাসহ পুরো খুলনা অঞ্চলে তাপমাত্রার পারদ ঊর্ধ্বমুখী। বিশেষজ্ঞদের মতে, আবহাওয়ার এই বিরূপ প্রভাবের ফলে কৃষি, জনস্বাস্থ্য, পানি সংকট ও জীববৈচিত্র্য বড় হুমকির মুখে পড়ছে।
গত রোববার (১১ মে) বিকেল ৩টায় খুলনায় তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা এ বছরের সর্বোচ্চ। একই সময় যশোর, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরাসহ গোটা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে তাপপ্রবাহ বইছে।
আবহাওয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী, খুলনায় ২০২০ সালে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৪.৪ ডিগ্রি, ২০২১ সালে ৩৬.৪, ২০২২ সালে ৩৫.২, ২০২৩ সালে ৪১.৩ এবং ২০২৪ সালে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ গত পাঁচ বছরে তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
এদিকে গত তিন দিনে প্রচণ্ড তাপপ্রবাহে খুলনায় জনজীবনে চরম অস্বস্তি বিরাজ করছে। তীব্র গরম অনুভূত হওয়ায় জরুরি প্রয়োজন ছাড়া মানুষ ঘরের বাইরে বের হচ্ছেন না। চলতি মে মাসের প্রথম সপ্তাহেও খুলনায় তাপমাত্রা মোটামুটি সহনীয় থাকলেও গত বৃহস্পতিবার থেকে বাড়তে শুরু করে মঙ্গলবারে এসে তা অগ্নিমূর্তি ধারণ করেছে।
অস্বাভাবিক গরমের কারণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা। বিশেষ করে খেটে খাওয়া মানুষ, শিশু ও বৃদ্ধরা পড়েছেন চরম ভোগান্তিতে। শ্রমজীবী মানুষ আগুনের হল্কা মাথায় নিয়েই বের হচ্ছে কাজের সন্ধানে। তীব্র দাবদাহে উত্তপ্ত বাতাসের বালিকণার ঝাপটা চোখেমুখে জ্বালা ধরাচ্ছে।
খুলনার শীববাড়ি মোড় থেকে সোনাডাঙ্গা এলাকায় রিকশা চালান ষাটোর্ধ্ব আব্দুল কাউয়ুম। মঙ্গলবার শীববাড়ি এলাকায় কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, ৩০ বছর ধরে খুলনা শহরে রিকশা চালাই। এত গরম আর রোদ আগে কোনোদিন দেখিনি। রাতে গরমে ঘুমাতে পারি না। দিনের বেলায় বাইরে বের হলেও আগুনের মতো রোদের তাপ সহ্য করা যাচ্ছে না। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের মতো মানুষের বাঁচা কঠিন হয়ে যাবে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, তাপমাত্রা ৩৬ থেকে ৩৭ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত মৃদু দাবদাহ, ৩৮ থেকে ৩৯ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত মাঝারি, ৪০ থেকে ৪১ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তীব্র ও তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রির বেশি হলে অতি তীব্র দাবদাহ গণ্য করা হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য কেবল বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন নয়, স্থানীয় কিছু অনিয়মও দায়ী। উন্মুক্ত জলাশয় ও বনভূমির হ্রাস, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, দখল-দূষণ এবং অনিয়ন্ত্রিত শিল্পায়ন খুলনা অঞ্চলের আবহাওয়াকে আরও উত্তপ্ত করে তুলছে।
খুলনা আবহাওয়া অফিসের সদ্য সাবেক আবহাওয়াবিদ আমিরুল আজাদ বলেন, গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ অঞ্চলে প্রতি বছরই তাপমাত্রা বাড়ছে। এর মূল কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। প্রায় প্রতি বছরই তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির কাছাকাছি পৌঁছাচ্ছে। এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে এ অঞ্চল আরও বড় বিপদের মুখে পড়বে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সয়েল, ওয়াটার অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. মো. সানাউল ইসলাম বলেন, খুলনায় খাল-বিল, জলাশয় ও সবুজ জায়গা দ্রুত হারে কমছে। অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ, রাস্তা ও শিল্প স্থাপন শহরকে এক রকমের গরম বাতাস জমে থাকা উত্তপ্ত চেম্বারে পরিণত করেছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা আগামী পাঁচ বছর অব্যাহত থাকলে এখানকার কৃষি, জনস্বাস্থ্য, পানি সংকট সব কিছু ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
মন্তব্য করুন