সিলেট ব্যুরো
প্রকাশ : ২১ মে ২০২৫, ০৩:৪৬ এএম
আপডেট : ২১ মে ২০২৫, ১২:৫২ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

এক কাপ চা ২০০ টাকা, শ্রমিকের মজুরি ১৭০

সিলেটের চা বাগান। ছবি : কালবেলা
সিলেটের চা বাগান। ছবি : কালবেলা

চা বাগানের শ্রমিকদের ভাগ্যের পরিবর্তন হচ্ছেই না। সরকার আসে সরকার যায়, কিন্তু তাদের জীবনের অনিশ্চয়তা কাটেনি। বাসস্থান, চিকিৎসা ও সুপেয় পানির অভাব তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি এখনো মাত্র ১৭০ টাকা। নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য বারবার আন্দোলন করেও তারা আজও ন্যায্য অধিকার পাননি। কিন্তু সিলেটের নামি দামি রেস্টুরেন্টে এক কাপ চায়ের দাম ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। সিলেটের ফুটপাতের চা স্টলগুলোতেও ২০ টাকার কমে এক কাপ চা পাওয়া যায় না।

শ্রমিকরা কালবেলাকে জানান, বছরের পর বছর এই বাগানে কাজ করলেও ভূমির অধিকার থেকে আজও বঞ্চিত। এই অধিকার দিতে সরকারের প্রতি দাবি জানান তারা। ন্যায্য মজুরি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, আবাসন, সুপেয় জল, স্যানিটেশনসহ কোনো কিছুরই সুবিধা পান না তারা। এক চা শ্রমিক হয়ে পাহাড়ের কোলে জন্ম নেওয়াটাই যেন তাদের ‘অপরাধ’।

ভোরে ঘুম থেকে উঠতে হয় চা শ্রমিকদের। কাঠফাটা রোদ আর বৃষ্টিতে ভিজে দিনভর সংগ্রহ করতে হয় চা পাতা। দুপুরে এক ফাঁকে চা পাতার চাটনি মেখে খান ভাত, কখনো সঙ্গে থাকে মুড়ি কিংবা ভাজা চাল- এভাবেই কাটে চা শ্রমিকের জীবন। খালি পায়ে, জোঁক আর বিষাক্ত সাপের সঙ্গে যুদ্ধ করে চা বাগানকে আঁকড়ে জীবন পার করেন তারা।

সবুজ কুঁড়িবেষ্টিত চা বাগানের সীমানাতেই আটকে আছে তাদের জীবন। বংশ পরম্পরায় যে জমিতে চা শ্রমিকরা বসবাস করেন, সেই জমিতে কখনোই মেলে না অধিকার। তাই মাথা গোঁজার আশ্রয়টুকু ধরে রাখতে হলে পরিবারের কাউকে না কাউকে বাগানে কাজ করতেই হয়। দিনশেষে ২৩ কেজি পাতা তুললেই তবে পূরণ হয় মাথাপিছু লক্ষ্যমাত্রা। এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হলেই তবে ‘হাজিরা’ হিসেবে গণ্য করা হয়। গাছ ছাঁটার সময় সারা দিনে অন্তত ২৫০টা চা গাছ ছাঁটতে হয়। কীটনাশক ছিঁটানোর বেলায় সারা দিনে কমপক্ষে ১ একর জমিতে কীটনাশক ছিটানোর লক্ষ্যমাত্রার বোঝা কাঁধে নিয়ে কাজ করতে হয় তাদের।

চা বাগানের মালিকদের ভাগ্যের উন্নয়ন হলেও শ্রমিকদরে কোনো উন্নয়ন হয় না। ২০২৩ সালের আগস্টে তৎকালীন সরকারের সময় তাদের দৈনিক মজুরি ৫০ টাকা বাড়ে। ফলে তাদের দৈনিক মজুরি দাঁড়ায় ১৭০ টাকায়। মজুরি নির্ধারণ নিয়ে যখন চা শ্রমিকদের আন্দোলন তুঙ্গে, তখন বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশনের ১০ সদস্যের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সরকারের উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হয়। বিশদ আলোচনার পর সরকার ৫০ টাকা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত দেয়। এর আগে স্থানীয় প্রশাসন ও শ্রম অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের চা শ্রমিক নেতাদের বৈঠকের পর ২৫ টাকা বাড়িয়ে ১৪৫ টাকা দৈনিক মজুরি ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু শ্রমিকদের একটি অংশ তাতে ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলেও বেশিরভাগ শ্রমিক তাতে রাজি হননি। পরে ৫০ টাকা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত আসে সরকারের কাছ থেকে।

সর্বশেষ ২০২০ সালে যখন চা শ্রমিক ইউনিয়ন এবং বাগান মালিকদের সংগঠন চা সংসদ মজুরি নিয়ে চুক্তি করেছিল, সে সময় মজুরি বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। সে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হয়নি।

সিলেটের মালনীছড়া বাগানের চা শ্রমিক রিপন বুনার্জি বলেন, আমরা অনেক কষ্টে থাকি, যা টাকা পাই সেটা দিয়ে কোনোমতে দিন পার করি। সেটাও মাঝে মাঝে বন্ধ হয়ে যায়। তখন আমাদের না খেয়ে থাকতে হয়।

চা বাগানগুলোতে নেই কোনো বিশেষজ্ঞ ডাক্তার। আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির পরিবর্তে এখনো তারা অতিপ্রাকৃত শক্তির ওপর নির্ভর চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহার করেন। এ কারণে অপুষ্টির শিকার হয় শিশুরা। চা বাগানগুলোতে এখনো প্রায় ৬০ ভাগ নারী শ্রমিক কাজ করেন। তাদের মাতৃত্বকালীন চিকিৎসা ও ছুটিও ঠিকমতো দেওয়া হয় না।

এ ছাড়া সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী সব চা বাগানে স্কুল প্রতিষ্ঠার কথা বলা হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। সরেজমিনে দেখা গেছে, সিলেটের অনেক চা বাগানে শিক্ষার আলো ছড়ানোর ব্যবস্থা নেই। যা আছে সেটা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংস্থার (আইএলও) বিধান অনুযায়ী, ৮ ঘণ্টা শ্রমের নিয়ম থাকলেও চা শ্রমিকদের কোনো শ্রমঘণ্টা নেই।

লাক্কাতুরা চা বাগানের শ্রমিক রুলী বলেন, সকাল ৬টা থেকে বিকেল পর্যন্ত চা পাতা তুলতে হয় আমাদের। পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যায় না, বাথরুম নেই। অসুখ হলেও টাকার অভাবে ডাক্তার দেখাতে পারি না। এরপরও আমাদের বেতন বৃদ্ধি হয় না, ঠিকমতো রেশন-ভাতা পাই না। আমাদের বেতন বাড়ানোর দাবি জানাই সরকারে কাছে।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সিলেট ভ্যালির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক রাজু গোয়ালা কালবেলাকে বলেন, শ্রমিকরা বাগানগুলোতে যেভাবে পরিশ্রম করেন সেভাবে বেতন-ভাতা পান না। আন্দোলন করে করে আমাদের এই জায়গায় আসতে হয়েছে। এখনো অসঙ্গতি রয়ে গছে। বাজার মূল্যের সঙ্গে মিল রেখে মজুরি নির্ধারণের জন্য তিনি সরকারের প্রতি দাবি জানান।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, চা শ্রমিকরা এ দেশে মানবেতর জীবনযাপন করে থাকেন। তারা যেখানে কাজ করেন সেখানকার ভূমিতে তাদের অধিকার নেই। শ্রমিকদের ব্যবহার করে মালিকপক্ষ ঠিকই লাভবান হচ্ছেন। চা শ্রমিকদের জীবন মান উন্নয়নে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।

প্রসঙ্গত, ১৮৫৪ সালে ভারতবর্ষের বাংলাদেশ অংশে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু হয় সিলেটের মালনীছড়া চা বাগানে। বাংলাদেশ চা উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে, দেশে চা বাগান রয়েছে ১৬৭টি। এর বড় অংশটি সিলেট, হবিগঞ্জ এবং মৌলভীবাজার এলাকায় অবস্থিত। এসব বাগানে এক লাখ ৪০ হাজারের মতো শ্রমিক রয়েছেন।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

জন্মাষ্টমী : সাংবাদিকদের সাথে পূজা পরিষদের মতবিনিময় বৃহস্পতিবার

রাহুল গান্ধীকে হত্যার হুমকি

সাদা পাথর উদ্ধারে যৌথ বাহিনীর অভিযান শুরু

বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে উয়েফা সুপার কাপে

স্বর্ণ পাচারে জড়িত সেই কেবিন ক্রু রুদাবা সাসপেন্ড

ইতালি উপকূলে অভিবাসীবাহী নৌকা ডুবে ২৬ জনের মৃত্যু

অফিসে হঠাৎ অসুস্থ বোধ করলে কী করবেন 

ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালককে গুলির পর কুপিয়ে হত্যা

হাজার কোটি টাকার মাদকদ্রব্য ধ্বংস 

চৌকি কোর্টে অভিযোগের হেল্পলাইন চালু

১০

রিমান্ড শেষে কারাগারে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক

১১

আ.লীগ পালিয়েছে ভারতে, আপনাদের পালাতে হবে পাকিস্তানে : টিপু

১২

গণপিটুনিতে নিহতের ঘটনায় দুই কর্মকর্তাসহ ৮ পুলিশ সদস্য বরখাস্ত

১৩

জামিন পেলেন বিএনপির ১৩ নেতাকর্মী

১৪

বাংলাদেশে নিজের বিচার নিয়ে টিউলিপের প্রতিক্রিয়া

১৫

সেনাপ্রধানের নামে সামাজিক মাধ্যমে ভুয়া অ্যাকাউন্ট, আইএসপিআরের সতর্কবার্তা

১৬

সাদা পাথর বাঁচাতে ৫ দফা সিদ্ধান্ত প্রশাসনের

১৭

যুক্তরাষ্ট্রে বার্সা-ভিয়ারিয়ালের ম্যাচ নিয়ে রিয়াল মাদ্রিদের আপত্তি

১৮

টঙ্গীতে মানববন্ধনে হামলা, আহত ৫

১৯

গলায় চানাচুর আটকে শিশুর করুণ মৃত্যু

২০
X