দেয়ালের একপাশে মসজিদে চলছে নামাজ আর অন্য পাশে শবদাহের কাজ। এ যেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের “মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান। মুসলিম তার নয়নমনি, হিন্দু তাহার প্রাণ” কবিতার প্রতিচ্ছবি।
প্রায় ৫০ বছর ধরে হিন্দু-মুসলিমের এমনি এক অপরূপ মেল বন্ধনের অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি উপজেলা সরাপপুর গ্রামে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আজ থেকে প্রায় ১৫০ বছর আগে তৎকালীন সরাপপুর গ্রামবাসী মিলে মরিচ্চাপ নদীর তীরে নিজেদের শবদাহের জন্য গড়ে তোলেন শ্মশান ঘাট। সেই থেকে স্থানীয়দের কাছে এটি সরাপপুর শ্মশান হিসেবে পরিচিত। অপরদিকে প্রায় বছর ৫০ আগে মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজন নদীর কূলে ওয়াপদার বাঁধের পাশে বসবাস শুরু করায় নামাজ আদায়ের জন্য শ্মশানে অদূরে গড়ে তোলেন পাঞ্জেগানা মসজিদ। কালের পরিক্রমায় মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজন বৃদ্ধি পাওয়াতে ১৯৯৩ সালে পাঞ্জেগানা মসজিদ রূপান্তরিত হয় জামে মসজিদে। সরাপপুর গ্রামে এই মসজিদে অবস্থান হলেও বর্তমানে এটি রহমতপুর জামে মসজিদ হিসেবে পরিচিত।
অন্যদিকে খরস্রোতা মরিচ্চাপ নদীতে ভাঙন দেখা দিলে স্থানীয় বড়বাবু খ্যাত রাজ্যশ্বর কুমার দাশের সহযোগিতায় নদী কূল থেকে কিছুটা পিছনে সরে এসে মসজিদে দেয়ালের ঠিক পূর্ব পাশে নতুন করে সুন্দর পরিবেশে গড়ে তোলা হয় শ্মশানের অবকাঠামো। আর সেই থেকে দেয়ালের এক পাশে চলছে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আর একই সময়ে কেউ মারা গেলে শ্মশানে চলে শবদাহের কাজ। শবদাহের সময় বাদ্যযন্ত্র বাজানো প্রথা থাকলেও মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে আজানের ধ্বনি ভেসে আসা থেকে নামাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত নিজেরাই বন্ধ রাখেন বাদ্যযন্ত্র। আবার দেহ পোড়ানোর গন্ধ যেন মুসলমানদের পরিচিত হয়ে উঠেছে। এসব নিয়ে কোনো পক্ষের নেই কোনো আপত্তি বা অভিযোগ। আর এভাবে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন সরাপপুরে গ্রামের মানুষ।
এ বিষয়ে সরাপপুর গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সন্তোষ কুমার দাশ বলেন, আমরা এখানে হিন্দু-মুসলমান মিলে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে বসবাস করছি। একই দেয়ালের এপাশে মসজিদ ও ওপাশে শ্মশান; কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো দিন আমাদের মাঝে কোনো সমস্যা হয়নি। নামাজের সময় যদি কোনো দাহ কাজ চলে তখন বাদ্যযন্ত্র বন্ধ রাখা হয় যাতে নামাজে কোনো সমস্যা না হয়।
স্থানীয় শংকর দাশ বলেন, এই শ্মশান ও মসজিদ আমাদের ঐতিহ্য। আমরা সেভাবেই মিলেমিশে বসবাস করছি।
মসজিদে মুসুল্লি আবুল হোসেন বলেন, আমরা মিলেমিশে আছি। আমরা একে অপরকে সাহায্য-সহযোগিতা করি। হিন্দু ভাইদের কেউ মারা গেলে তারা দাহ করতে আসে। ঢোলসহ বাদ্যযন্ত্র বাজায়। আমরা কোনো দিন তাদের বলি না তারপরও তারা নিজেরাই নামাজের সময় বাজনা বন্ধ রাখে।
মন্তব্য করুন