সৈকতের বালু লুট, ঝাউগাছ কর্তন, মাটি বিক্রি ও মৎস্য ঘেরের নামে দখলদারিত্ব চলছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রসৈকত চট্টগ্রামের আনোয়ারা পারকি সৈকত। কর্ণফুলী টানেল নির্মিত হওয়ার পর দখলের মহোৎসব শুরু হয়েছে। প্রভাবশালীরা সৈকতের বাঁধ পর্যন্ত কেটে নিয়েছে।
বর্তমানে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বাড়তি ৪৯ কোটি টাকা খরচ করে নির্মাণ করছে নতুন কংক্রিটের বাঁধ। বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন পারকিকে পর্যটন এলাকা ঘোষণা করে নানা পরিকল্পনা ও বরাদ্দ দিয়েছিল। কিন্তু ৩০ বছরেও সরকার কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেনি। উল্টো সৈকতে চলছে প্রভাবশালীদের দখল-বাণিজ্য।
সম্প্রতি সরেজমিনে সৈকতে গিয়ে দেখা যায়, সৈকতের প্রবেশমুখে বেড়িবাঁধ ঘেঁষে এক্সক্যাভেটর দিয়ে চলছে খনন কাজ। সৈকতের ঝাউগাছগুলো অধিকাংশই কেটে নিয়ে গেছে। মৎস্য ঘেরের নামে সৈকতের উত্তর পাশে মাটি কেটে নিয়ে পুকুর বানিয়ে ফেলেছে। সৈকতের উত্তর থেকে দক্ষিণ প্রান্তজুড়ে দখলের মহোৎসব।
জানা যায়, আনোয়ারা উপকূলকে রক্ষা করার জন্য বন বিভাগ ১৯৯৩-৯৪ সালে প্রায় ৮০ হেক্টর জায়গায় ঝাউগাছ রোপণ করে। আর্কিটেকচারাল পদ্ধতিতে লাগানো এ গাছ বড় হয়ে উঠলে পরে পারকি পর্যটন এলাকা হিসেবে রূপ লাভ করে। পারকির ঝাউবনে বসে একসঙ্গে বহির্নোঙরের জাহাজ সারির আসা-যাওয়া ও সৈকতের লাল কাঁকড়ার বিচরণ উপভোগ করা যায়। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত কর্ণফুলী টানেল পারকির আকর্ষণ বাড়িয়েছে বহুগুণ। সৈকতের কোলজুড়ে গড়ে উঠেছে টানেল সার্ভিস এরিয়া নামে আধুনিক ভবন ও বিনোদন কেন্দ্র। এতে ভিআইপি হোটেল, মিলনায়তন ও বিনোদন কেন্দ্রসহ অত্যাধুনিক সব ব্যবস্থা রয়েছে। চট্টগ্রাম শহর থেকে টানেল হয়ে মাত্র তিন মিনিটে সৈকতে আসা যায় বলে পর্যটকদের কাছে এর গুরুত্ব অনেক বেড়ে গেছে।
সরকার ও পর্যটন করপোরেশন পারকি সৈকতকে আধুনিক পর্যটন এলাকায় পরিণত করতে ৩০ বছর ধরে পরিকল্পনার শেষ রাখেনি। পর্যটন করপোরেশন ও পাউবোর বরাদ্দও থেমে নেই। কিন্তু এসব পরিকল্পনা ও বরাদ্দে পারকি সৈকতে উন্নয়নের ছোঁয়া স্পর্শ করেনি। বরং দখল করে সৈকত প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছেন প্রভাবশালীরা। রাত হলেই চলে সৈকতের বালু উত্তোলন, খাসজমির মাটি খননে ডাম্প ট্রাক আর এক্সক্যাভেটরের ঘড়ঘড় শব্দ।
সৈকতের বেড়িবাঁধ ফুলতলী মৌজার ৫২৯ দাগে প্রায় সাড়ে ১০ একর জায়গাজুড়ে পানি চলাচলের জন্য একটি জলাধার ছিল। এ জলাধারটি ফুলতলী থেকে পারকি খালে এসে মিলিত হয়। এ জায়গার মালিকানা পাউবোর। কিন্তু ভূমি কার্যালয়ের খাতায় জলাধার থাকলেও সরেজমিন এর কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। জলাধারের জমিতে এখন গড়ে উঠেছে প্রভাবশালীদের মৎস্য ঘের আর বিনোদন কেন্দ্র। সৈকতের রিংবাঁধ কেটে মৎস্য ঘেরের পানিপ্রবাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এতে করে সৈকতের বালু ও ঝাউগাছের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। লন্ডভন্ড হয়ে পড়েছে পারকি সৈকত। এজন্য পাউবোকে নতুন করে ৪৯ কোটি টাকা ব্যয়ে বাঁধ নির্মাণ করতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন ফুলতলী মৌজায় তিন হাজার ৮৮৩ একর খাসজমির মধ্যে পারকি সমুদ্রসৈকত ট্যুরিজম জোন গড়ে তোলার কাজ চলছে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে সৈকত এলাকায় ১৩ দশমিক ৩৩ একর জায়গায় ৭৯ কোটি টাকা ব্যয়ে পারকি পর্যটন কমপ্লেক্সের নির্মাণকাজ শুরু হয়। ৬ বছরে দুইবার মেয়াদ আর বরাদ্দ বাড়িয়ে ৬০ শতাংশ কাজও শেষ করতে পারেনি পর্যটন করপোরেশন। কাজ যতটুকু শেষ হয়েছে, তা-ও নিম্নমানের। এরই মধ্যে সীমানা প্রাচীর ভেঙে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। নির্মাণকাজে অনিয়মের খবরে পর্যটনমন্ত্রী থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা পরিদর্শনে এলেও দায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি; কাজের অগ্রগতিও বাড়েনি।
গত ১৫ মে উপজেলা মিলনায়তনে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা ও আনোয়ারার পারকি সমুদ্রসৈকতে ট্যুরিজমের সম্ভাবনা নিয়ে কনসালটেশন সভায় বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের যুগ্ম সচিব (প্রশাসন ও অর্থ) আবু সেলিম মাহমুদ-উল হাসান জানান, পারকি সমুদ্রসৈকত অপার সম্ভাবনাময় পর্যটন এলাকা। কর্ণফুলী টানেল, টানেল সার্ভিস এরিয়া, বিভিন্ন কল-কারখানাসহ এখানে পর্যটনের জন্য যেসব উপকরণ রয়েছে, তাতে বিপুলসংখ্যক কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। ইকো ট্যুরিজম ও কৃষিভিত্তিক ট্যুরিজমেরও সুযোগ রয়েছে এখানে।
দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদস্য সচিব লায়ন হেলাল উদ্দিন বলেন, পারকি সৈকত চট্টগ্রামকে পর্যটন নগরে রূপ দিয়েছে। দখলদারিত্ব ও ভূমিদস্যুদের দমন করতে না পারলে সৈকতের সৌন্দর্য হারিয়ে যাবে। এ বিষয়ে প্রশাসনের সহযোগিতা দরকার।
পাউবো চট্টগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী শওকত ইবনে সাহীদ বলে, অবৈধ দখল উচ্ছেদ করা হবে। পারকি সৈকত রক্ষায় সৈকত ঘেঁষে ৪৯ কোটি টাকা ব্যয়ে পাথরের বাঁধ নির্মাণকাজ চলছে। এ কাজ সম্পন্ন হলে পারকির ঝাউগাছসহ সৈকত অনেকটা নিরাপদ হবে।
আনোয়ারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাহমিনা আক্তার কালবেলাকে বলেন, পারকি সৈকত পর্যটন শিল্পে অপার সম্ভাবনাময় এলাকা। সরকারের গৃহীত উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে পারকি দেশসেরা পর্যটন নগরীতে পরিণত হবে। এ সৈকত রক্ষায় সব ধরনের আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানান ইউএনও।
মন্তব্য করুন