বিশিষ্ট শিক্ষা অনুরাগী মানবহিতৈষী আলহাজ সাইফুদ্দিন কাদের চৌধুরীর দশম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে এক স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে বক্তারা তার জীবন ও কর্মের নানা দিক তুলে ধরেন।
শুক্রবার (৩০ মে) রাতে চট্টগ্রাম ক্লাব মিলনায়তনে এই স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার কয়েক শত লোক অংশ নেন।
বিশিষ্ট সাংবাদিক ওসমান গনি মনসুরের সভাপতিত্বে ও চট্টগ্রাম ক্লাবের সাবেক সভাপতি ডা. মইনুল ইসলাম মাহমুদের সঞ্চালনায় সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ব্র্যাকের চেয়ারম্যান, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাক্তন উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। গেস্ট অব অনার হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাবেক মহাহিসাব নিয়ন্ত্রক ও নিরীক্ষক, সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো. মুসলিম চৌধুরী। বিশেষ মেহমান হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট শিপিং ব্যবসায়ী মরহুমের ছোট ভাই জামাল উদ্দিন কাদের চৌধুরী, স্বাগত বক্তব্য রাখেন মরহুমের কনিষ্ঠ সন্তান সাকিব কাদের চৌধুরী।
অনুষ্ঠানে সাইফুদ্দিন কাদের চৌধুরীর স্মৃতিচারণ করে বক্তারা বলেন, তিনি ছিলেন সমাজের এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। মানুষের উপকার করাই যেন ছিল তার নেশা। তিনি এমনভাবে দান ও মানুষের সেবা করতেন, যেন ডান হাতে জানলে বাম হাত জানত না। তিনি একজন ধার্মিক মানুষ হলেও মনেপ্রাণে অসাম্প্রদায়িক চেতনা লালন করতেন। তিনি দলীয় ও ধর্মীয় মতাদর্শের ঊর্ধ্বে উঠেই মানুষের সেবা করতেন। তার এসব অনুকরণীয় দৃষ্টান্তই তাকে মানুষের মাঝে বাঁচিয়ে রাখবে। সরলতা, নম্রতা ও মানুষের জন্য বুকভরা দরদই ছিল তার মূল সম্পদ। তিনি অসহায়দের জন্য সহায় ছিলেন।
স্বাগত বক্তব্যে সাইফুদ্দিন কাদের চৌধুরীর কনিষ্ঠ ছেলে সাকিব কাদের চৌধুরী বলেন, আমার বাবা রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হয়েও রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন না। তাকে অনেক দল রাজনীতিতে যুক্ত হতে ডেকেছে। তবে ক্ষমতার মোহ তাকে কখনও টানে নাই। তিনি বলতেন, ক্ষমতা ও পয়সা চিরদিন থাকে না। তবে ভালো কাজের ফল সবসময় থাকে।
তিনি বলেন, আমার বাবা প্রচুর বই পড়তেন। তিনি গান শুনতে ভালোবাসতেন। তিনি ১৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করে গেছেন। বাবা-মার প্রতি তার এতই শ্রদ্ধা ছিল, সব তাদের নামেই করেছেন। তিনি যখন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন, তখন ক্যানসারের চিকিৎসার অত্যধিক ব্যয়ের কথা চিন্তা করে একটি ক্যানসার হাসপাতাল বানানোর চিন্তা করেছিলেন। যদিও শেষ পর্যন্ত তা করতে না পারলেও চোখের হাসপাতাল করেছেন।
তিনি আরও বলেন, মৃত্যুর আগে গরিবদের জন্য একটি কনভেনশন সেন্টার করে গেছেন। মানুষজন তাকে তার হৃদয়ের বিশালতার জন্যই ভালোবাসে। তিনি ক্রিকেট খেলা অসম্ভব ভালোবাসতেন। বিভিন্ন ক্রিকেট ক্লাবে অনুদান দিতেন।
বাবার স্মৃতি ধরে রাখতে দুটি কার্যক্রম হাতে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন শাকিব কাদের চৌধুরী। সাইফুদ্দিন কাদের চৌধুরী ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করা ও রাউজানে একটি ক্রিকেট একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা। এই ক্রিকেট একাডেমি বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক তামিম ইকবালের হাত ধরে যাত্রা শুরু করবে।
গেস্ট অব অনারের বক্তব্যে সাবেক মহাহিসাব নিয়ন্ত্রক ও নিরীক্ষক, সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো. মুসলিম চৌধুরী বলেন, আমার বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। আমি দেখেছি সময় বাড়তে থাকলে শ্রোতাও কমতে থাকে। কিন্তু আমি এই অনুষ্ঠানে এসে অবাক হয়েছি। দশ বছর পরেও একটি স্মরণসভায় এত মানুষ দেখে আমি অভিভূত। সন্ধ্যা সাতটায় এসে রাত এগারোটা পর্যন্ত বসে শ্রোতারা পিনপতন নীরবতায় তার জীবন ও কর্ম সম্পর্কে শুনেছেন। তিনি কেমন মানুষ ছিলেন এটাই তো তার প্রমাণ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ব্র্যাকের চেয়ারম্যান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, আমরা স্কুল থেকে এক সঙ্গে সময় কাটিয়েছি। তবে এই স্মরণসভায় এসে তার চরিত্রের অনেক দিক নতুনভাবে উন্মোচিত হলো।
তিনি বলেন, আমাদের সমাজ থেকে আত্মবিমুখ সেবার মানসিকতা হারিয়ে গেছে। এখন সবাই নিজেকে জাহির করতে চায়। এজন্য আমাদের বন্ধুর বিভিন্ন দিক শিক্ষণীয়। আজ এখানে সবাই সাইফুদ্দিনের ব্যক্তিত্বের সাক্ষ্য দিচ্ছেন।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের শিক্ষার বিস্তার হয়েছে ঠিকই। তবে মানের অবস্থা বেহাল। শিক্ষার প্রতি অনুরাগী ছাড়া এ বেহাল অবস্থা থেকে বের হওয়া সম্ভব না। সাইফুদ্দিন ছিলেন একজন শিক্ষার প্রতি অনুরাগী মানুষ। ইচ্ছা করে প্রতি অনুরাগ না থাকলে কিছুই করা সম্ভব না। আজ আমরা স্মরণ করার মাধ্যমে আমাদের কোথায় কোথায় ঘাটতি আছে তা জানতে পারছি। আমাদের আত্মোপলব্ধি একটা জায়গা তৈরি হয়েছে। স্মরণসভায় প্রত্যেকে নতুন নতুন উপাদান নিয়ে এসেছেন। অনুষ্ঠানে প্রাণবন্ত উপস্থিতি আমাদের আত্মমূল্যায়নের বিষয়টি শেখাচ্ছে।
সভায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট চিকিৎসক ডা. সুভাষচন্দ্র ধর, বার্থ অপারেটর অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ইকরাম চৌধুরী, বিশিষ্ট চিকিৎসক ডা. ওমর ফারুক, সেলিমা কাদের চৌধুরী ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ মোহম্মদ হোসাইন মোহাম্মদ, রহিমপুর ফজলুল কাদের চৌধুরী স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ আবুল মনসুর ফজলে হাবিব, বিশিষ্ট মানবাধিকার আইনজীবী জিয়া হাবিব আহসান, মরহুমের দীর্ঘদিনের সহকর্মী মো. হাসান রুমি প্রমুখ।
মন্তব্য করুন