প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অফিস সহায়ক কাম নৈশ প্রহরী (৪র্থ শ্রেণির কর্মচারী) সুমন মিয়া গত ১১ বছর ধরে বিদ্যালয়ে যান না। কিন্তু নিয়মিত বেতনভাতা উত্তোলন করছেন। সুমনের বদলে স্বপ্না সাহা নামের এক নারী বিদ্যালয়ে কাজ করেন। ফলে বেতনের একটা অংশ স্বপ্নাকে দিয়ে সরকারি বেতন-ভাতার বাদবাকি অর্থ আত্মসাৎ করছেন তিনি।
টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার দিগর ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ভিটিপাড়া কাশতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এ ঘটনা ঘটেছে।
জানা গেছে, উপজেলার কাশতলা ভিটিপাড়া গ্রামের আব্দুর রহমানের ছেলে সুমন মিয়া আওয়ামী সরকারের আমলে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে বিশেষ সুবিধায় কাশতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অফিস সহায়ক কাম নৈশ প্রহরীর চাকরি নেন। তারপর থেকেই তিনি ব্যক্তিগত ব্যবসা বাণিজ্য আর ব্যস্ততার কারণে বিদ্যালয়ে নিয়মিত উপস্থিত হন না। তাই সহায়ক কিছু কাজকর্মে সহায়তা করার জন্য স্বপ্না সাহা নামে এক নারীকে ব্যক্তিগতভাবে বিদ্যালয়ে নিয়োগ দিয়েছেন তিনি। বিদ্যালয় থেকে প্রাপ্ত বেতনের একটা অংশ স্বপ্নার হাতে তুলে দেন।
সুমন প্রতি মাসে ১৬ হাজার ৬৭৩ টাকা হারে বেতন পান। এতে করে তিনি গত ১১ বছরে বিদ্যালয়ের দায়িত্ব পালন না করেই অন্তত ২০ লক্ষাধিক টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এই অর্থের সামান্য একটা অংশ তার বদলে নামেমাত্র দায়িত্ব পালন করা স্বপ্না সাহার হাতে তুলে দিয়েছেন তিনি।
সম্প্রতি কাশতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, সুমনের পরিবর্তে দায়িত্ব পালন করছেন স্বপ্না সাহা নামের এক নারী। সে সময়ে যথারীতি বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত সুমন মিয়া।
স্বপ্না সাহাকে কোন পদে চাকরি করছেন জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, আমি কোনো পদে চাকরি করি না। সুমন দাদা আমাকে এই চাকরিটা দিয়েছেন। প্রতি মাসে সুমন দাদাই আমাকে বেতন দেন। আমার স্বামী মারা যাওয়ায় দাদা আমাকে এই কাজটা দিয়েছেন। মাস শেষে দাদাই আমাকে বেতন দেন এবং বিদ্যালয় থেকে আমাকে কোনো অর্থ দেওয়া হয় না।
ভিটিপাড়া কাশতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সে সময়ে উপস্থিত সহকারী শিক্ষক শাহনাজ আকতার, সুলতানা বিলকিস, ইমরান মাহমুদ, চায়না রানী সাহা প্রমুখ। সুমন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে সবাই এক বাক্যে বলেন, সে নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসে না, তার বদলে স্বপ্না সাহা নামের এক নারী কাজ করেন। খুব বেশি প্রয়োজন হলে তাকে মোবাইল ফোনে কল করে বিদ্যালয়ে ডেকে আনতে হয়।
বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শাহনাজ আকতার বলেন, সুমন মাসে দুই এক দিন বিদ্যালয়ে আসে। কোনো জরুরি কাজে দরকার হলে তার মোবাইল ফোনে কল করে বলতে হয়, আজকে এই কাজ আছে একটু আসলে ভালো হয়। তখন সে স্বল্প সময়ের জন্যে আসে। সুমনের বদলে এক নারী কাজ করেন। তাকে বিদ্যালয় থেকে আমরা কোনো টাকা দিই না। সুমন সম্ভবত তাকে টাকা দেয়, টাকা ছাড়া তো আর কেউ এমনি এমনি কাজ করে দেবে না।
সহকারী শিক্ষক ইমরান মাহমুদ বলেন, সাত দিন, পনের দিন পর পর বিদ্যালয়ে এসে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করে চলে যায় সুমন। চাকরি ছাড়াও তার নিজস্ব কিছু ব্যবসা বাণিজ্য আছে, সেগুলো দেখাশোনা করেন তিনি। তাই তিনি বিদ্যালয়ে আসার সময় পান না।
শিক্ষক চায়না রানী সাহা বলেন, নিয়মিত স্কুলে না আসার বিষয়ে কথা বলতে গেলে সুমন জানিয়েছে, আমারটা আমি দেখব, আপনারা কোনো কথা বলবেন না। আমরা তাই তাকে কোনো কিছু বলি না।
ভিটিপাড়া কাশতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাকিলা নাহার বলেন, সুমনের নিয়মিত বিদ্যালয়ে না আসার বিষয়টি সত্য। সহকর্মীরা সবাই আমাকে সতর্ক করে বলেছে যে, তাকে কিছু বলা যাবে না। সে যেভাবে বিদ্যালয়ে আসে তাকে সেভাবেই আসতে দিতে হবে। তারপরেও কিছু দিন আগে সুমনকে ডেকে এনে সতর্ক করে বলেছি, অনেক দিন তো হলো এবার চাকরিটা বাদ দাও। এখনকার পরিস্থিতি অন্য রকম। আগে যেমন যা যেভাবে করেছ, এখন সেভাবে তা করা যাবে না। কিন্তু এসব কথার কোন গুরুত্ব নেই তার কাছে।
সুমনের বিরুদ্ধে এর আগে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কিনা জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক বলেন, সুমনের এই বিষয়টি সবাই জানে। আশপাশের শিক্ষকরা, শিক্ষক নেতারা কেউ কিছু তাকে বলেন না।
এসব অভিযোগ অস্বীকার করে সুমন মিয়া বলেন, আমি নিয়মিত স্কুলে আসি। এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ ভুল, মিথ্যা। আপনি আমার এলাকায় যান, তাদের কাছে শোনেন। আমার টিচার আছেন, তাদের কাছে জিজ্ঞাসা করেন। টিচাররা যদি বলেন, আমি আসি না, তাহলে আমার বিরুদ্ধে যা আইনানুগ ব্যবস্থা নেবেন আমি রাজি।
তার পরিবর্তে স্বপ্না নামের একজনের কাজ করার বিষয়ে তিনি বলেন, আমি ওই নারীকে চাকরি দেওয়ার কেউ না। দুইটি সন্তান রেখে ওনার স্বামী মারা গেছে, কোনো কাজকর্ম নেই। সেজন্যে আমি তাকে বলেছি, ‘তুমি আমার স্কুলে আইসা টুকিটাকি ঝাড়ুটাড়ু দিলা, টুকটাক ফুটফরমায়েস করলা। বিনিময়ে আমি তোমাকে আর্থিক সহযোগিতা করব। মাস গেলে তাকে কিছু আর্থিক সয়াহতা করি, বাচ্চাদের স্কুলের খরচা দিই।
উপজেলা শিক্ষা অফিসার রাফিউল ইসলাম বলেন, বিদ্যালয়ের অফিস সহকারী কাম নৈশ প্রহরীর কাজ অন্যকে দিয়ে করানোর সুযোগ নেই। আমরা বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষককে কারণ দর্শানোর চিঠি দিয়েছি। সেটি পেলে আমরা তদন্ত সাপেক্ষে ওই অফিস সহায়ক বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) আবু সাইদ বলেন, বিদ্যালয়ে ঠিকমতো দায়িত্ব পালন না করে বদলি কাউকে দিয়ে ডিউটি করানোর অভিযোগটি গুরুতর। এভাবে তিনি গত ১১ বছর ধরে নিয়মিত বেতন ভাতাও উত্তোলন করছেন, শুনেছি। এতে কর্তৃপক্ষের অবহেলা রয়েছে বলে মনে হচ্ছে, তা না হলে দীর্ঘদিন ধরে এমন অনিয়ম চলতে পারে না। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ লিখিতভাবে অভিযোগ দিলে বিষয়টি দ্রুততার সঙ্গে আমলে নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।
মন্তব্য করুন