প্রশাসনিক অঙ্গনে যখন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠে, তখন একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা আমাদের নতুন করে আশাবাদী করে তোলে। ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার বিদায়ী সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. ওয়াহিদুর রহমান এমনই এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। সরকারি অর্থ ফেরত দিয়ে দেখিয়েছেন সততা এখনও বেঁচে আছে এবং তা অনুশীলনযোগ্য।
মো. ওয়াহিদুর রহমান দীর্ঘ ৯ বছর ৩ মাস ১১ দিন সোনাগাজী উপজেলায় সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তার দায়িত্ব পালনের পর সম্প্রতি বদলি হয়ে নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলায় যোগদান করছেন।
দায়িত্ব পালনকালে তিনি বিদ্যালয়ভিত্তিক বিভিন্ন সরকারি কর্মসূচি, যেমন-মা সমাবেশ, কৃতী শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা, সাব-ক্লাস্টার প্রশিক্ষণ ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ করেন। এ ধরনের প্রোগ্রামগুলোতে সচরাচর কোনো সরকারি আপ্যায়ন বরাদ্দ থাকে না। অনেক সময় শিক্ষকরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেন। যদিও তিনি যোগদানের পর প্রত্যেক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে জানিয়ে দেন—সরকারি অর্থে যেন কোনো আপ্যায়ন আয়োজন না হয়।
তবুও হয়তো কোথাও অনিচ্ছাকৃতভাবে তার অজ্ঞাতসারে সরকারি বরাদ্দের কোনো খাবার গ্রহণ করা হয়ে থাকতে পারে—এই উপলব্ধি থেকেই নিজের বিবেকের দায় মেটাতে তিনি মোট ৬৫ হাজার টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরত দেন। তিনি এ টাকা বুধবার (৩১ জুলাই) সোনাগাজী সোনালী ব্যাংক শাখায় চালানের মাধ্যমে জমা দেন।
এর মধ্যে রয়েছে, অনিচ্ছাকৃতভাবে সরকারি অর্থে খাবার গ্রহণের সম্ভাব্য খরচ : ৫৬ হাজার ৬০০ টাকা। ২০১৬ সালের সাব-ক্লাস্টার প্রশিক্ষণে ২১০ জন উদ্বৃত্ত অংশগ্রহণকারীর জন্য (প্রতি জনে ৪০ টাকা): ৮ হাজার ৪০০ টাকা। সব মিলিয়ে মোট জমাকৃত অর্থ ৬৫ হাজার টাকা।
এ বিষয়ে শিক্ষা কর্মকর্তা মো. ওয়াহিদুর রহমান বলেন, ‘এ অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য আমি সবার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আমি চাই না আমার দ্বারা কিংবা আপনাদের কারও দ্বারা এ রকম কিছু হোক। আমাদের সতর্ক থাকতে হবে যেন সরকারের একটি টাকাও অপচয় না হয়। প্রতিটি টাকার পেছনে জনগণের রক্ত-ঘাম জড়িয়ে আছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা যদি নিজ নিজ অবস্থান থেকে দায়িত্বশীল হই, তবে প্রশাসনিক খাতে দুর্নীতি দূর হবে এবং দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। আসুন, আমরা সবাই মিলে কালচার পরিবর্তন করি।’
এ বিষয়ে উপজেলার বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তারা মন্তব্য করে জানান, এটি শুধু অর্থ ফেরতের ঘটনা নয়, বরং এটি মূল্যবোধের জীবন্ত উদাহরণ। এমন পদক্ষেপ দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় অন্যদের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে।
উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এসএম তাহেরুল ইসলাম বলেন, ‘তিনি যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা আমাদের প্রশাসনিক ও নৈতিক জীবনের জন্য এক বড় শিক্ষা। সরকারি অর্থ ফেরত দিয়ে তিনি প্রমাণ করেছেন—সততা শুধু বক্তৃতার বিষয় নয়, এটি বাস্তবেও প্রয়োগ করা যায়। আমরা তার এ উদ্যোগকে সম্মান জানাই।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রিগ্যান চাকমা বলেন, বর্তমান সময়ে যখন অনেকেই দায়িত্বের চেয়ে সুবিধার কথা ভাবেন, তখন একজন কর্মকর্তা নিজের বিবেকবোধ থেকে এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত প্রশংসনীয়। এটি শুধু একজন কর্মকর্তার সততার পরিচয় নয়, বরং এটি প্রমাণ করে—প্রশাসনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির চর্চা এখনও সম্ভব।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার ফিরোজ আহাম্মদ বলেন, বিদায়ী সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. ওয়াহিদুর রহমান যে নজির স্থাপন করেছেন, তা নিঃসন্দেহে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য একটি গর্বের বিষয়। সরকারি অর্থ ফেরত দেওয়ার মতো সাহসী পদক্ষেপ আজকের দিনে বিরল। প্রাথমিক শিক্ষা পরিবারে এমন উদাহরণ নতুন প্রজন্মের কর্মকর্তাদের জন্য পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করবে।
মন্তব্য করুন