রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলা মডেল মসজিদ ও ইসলামী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, বাজার বড় মসজিদসহ উপজেলার অধিকাংশ মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিন অনুপস্থিত রয়েছেন। নুরাল পাগলের দরবারে হামলা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, কবর থেকে মৃতদেহ তুলে পুড়িয়ে দেওয়া ও পুলিশের গাড়ি ভাঙচুরসহ পুলিশ সদস্যদের পিটিয়ে আহত করাকে কেন্দ্র করে গ্রেপ্তার আতঙ্কে আত্মগোপনে চলে গেছেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ইমাম-মুয়াজ্জিন না থাকায় উপস্থিত মুসুল্লিদের মধ্য থেকে অনেকে আজান ও নামাজে ইমামতি চালিয়ে নিচ্ছেন। এতে করে ৫ ওয়াক্ত নামাজ জামায়াতে সম্পন্ন হলেও আদায় করা নামাজ সহিহ-শুদ্ধ হচ্ছে কি না তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন সাধারণ মুসল্লিরা। এ সংশয় থেকে প্রতিটি মসজিদে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে মুসল্লির সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে।
গত ৫ সেপ্টেম্বর নুরাল পাগলার মাজারে হামলার পরদিন ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার ব্যক্তিকে আসামি করে গোয়ালন্দ ঘাট থানায় একটি মামলা দায়ের করেন গোয়ালন্দ ঘাট থানার এসআই মো. সেলিম মোল্লা। এরপর থেকেই উপজেলার বিভিন্ন স্থানে গ্রেপ্তার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ মামলায় শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ ছাড়া দরবারে হামলার ঘটনায় নিহত রাসেল মোল্লার (২৮) বাবা আজাদ মোল্লা বাদী হয়ে সোমবার (০৮ সেপ্টেম্বর) রাতে গোয়ালন্দ ঘাট থানায় একটি হত্যা মামলা করেছেন। এ মামলায় ৪ হাজার অজ্ঞাত ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। এরই মধ্যে দুজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে।
মঙ্গলবার সকাল ১০টার দিকে উপজেলার আল জামিয়া নিজামীয়া আরাবিয়া কওমি মাদ্রাসায় গিয়ে দেখা যায়, যেখানে শত শত শিক্ষার্থীর হৈচৈ ছিল, সেখানে সুনসান নীরবতা। পুরো মাদ্রাসাজুড়ে খোঁজ করে কাউকেই খুঁজে পাওয়া গেল না।
এ সময় স্থানীয়রা জানান, মামলা দায়েরের পর থেকে মাদ্রাসা ছুটি দিয়ে সবাই চলে গেছে।
উপজেলার বিভিন্ন মসজিদে অনুপস্থিত থাকা ইমাম-মুয়াজ্জিনদের ফোনও বন্ধ পাওয়া যায়। তাই অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
গোয়ালন্দ উপজেলার ছোট ভাকলা ইউনিয়নের চরবালিয়াকান্দি দারুসসালাম জামে মসজিদের ইমাম হাফেজ মোহাম্মদ হাসান জানান, তিনি স্বাভাবিকভাবেই মসজিদে ইমামের দায়িত্ব পালন করছেন। কারণ তিনি শুক্রবার (০৫ সেপ্টেম্বর) ইমাম কমিটির কর্মসূচিতে উপস্থিত ছিলেন না। তাই তার কোনো ভিডিও ফুটেজে থাকার কথাও না। এ কারণে তিনি নির্ভয়ে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।
তিনি বলেন, গোয়ালন্দে একটি বড় ধরনের ঝামেলা হয়েছে। ওই ঘটনায় অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। তাই অনেকেই গ্রেপ্তার আতঙ্কে ছুটিতে থাকতে পারেন।
গোয়ালন্দ বাজারের ব্যবসায়ী মো. গোলাম মোস্তফা জানান, কয়েক দিন ধরে বাজারের বড় মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন অনুপস্থিত। কে আজান দেবে, কে ইমামতি করবে তার কোনো ঠিক নেই। এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। এ সময় তিনি গোয়ালন্দে যে ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে, এটা বিশ্বাস করতেই কষ্ট হয় বলে জানান তিনি।
অপর ব্যবসায়ী আলহাজ আসাদ উদ দৌলা বলেন, ‘হুজুরদের বাড়াবাড়ির কারণে গোয়ালন্দে এত বড় একটা পৈশাচিক ঘটনা ঘটে গেল, যা ইতিহাসে বিরল। একটু ধৈর্য ধরলে বিষয়টি শান্তিপূর্ণভাবেও সমাধান করা যেত। আর সেটা হলে এতবড় একটা ম্যাসাকার হতো না।’
এ বিষয়ে গোয়ালন্দ উপজেলা ইমাম কমিটির সভাপতি মাওলানা জালাল উদ্দিন জানান, গত ৫ সেপ্টেম্বরের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে একটি হত্যাসহ দুটি মামলা হয়েছে। মামলাগুলোতে সাড়ে ৭ থেকে ৮ হাজার মানুষকে আসামি করা হয়েছে। মূলত গ্রেপ্তার আতঙ্কে গোয়ালন্দের বেশিরভাগ মসজিদ ইমাম-মুয়াজ্জিন শূন্য হয়ে পড়েছে। বিষয়টি কারও জন্যই কাম্য না।
গোয়ালন্দ বাজার বড় মসজিদ পরিচালনা কামিটি কোষাধ্যক্ষ ও গোয়ালন্দ বাজার ব্যবসায়ী পরিষদের সভাপতি মো. ছিদ্দিক মিয়া জানান, বড় মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন হঠাৎ করে উধাও হয়ে গেছে। তারা কাউকে কিছুই বলে যায়নি। মুয়াজ্জিনের মা তার বেতনের টাকা নিয়ে গেছে, তিনিও বলতে পারেননি তার ছেলে কোথায় আছে। আপাতত মুক্তাদিরা ওয়াক্তের নামাজ চালিয়ে নিচ্ছেন।
গোয়ালন্দ ঘাট থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ রাকিবুল ইসলাম জানান, ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে এবং অন্যান্য তথ্যের ভিত্তিতে দোষীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এখানে নিরাপরাধ কোনো ব্যক্তির আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।
তিনি জানান, শুক্রবার জুমার আগের দিন উপজেলার সব ইমামদের কাছে চিঠি দিয়েছিলেন যে, মাজার বা দরবার ভাঙচুরের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতের রায় রয়েছে। তারা যেন মুসল্লিদের শান্ত রাখতে সহযোগিতা করে।
এ বিষয়ে রাজবাড়ী জেলা জামায়াতের আমির অ্যাড. নুরুল ইসলাম বলেন, ‘একটি মসজিদের ইমাম অবশ্যই সংশ্লিষ্ট এলাকার একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তার কথায় অনেকেই আবেগী হয়ে পড়ে। সুতরাং তাদের আরও সতর্কতার সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা বা বয়ান করা উচিত ছিল বলে আমি মনে করি। আর গোয়ালন্দে কবর থেকে যে লাশ তুলে পোড়ানো হয়েছে, দলীয়ভাবেও কোনোভাবে এটা সমর্থনযোগ্য নয়। তবে এ ঘটনায় যেন কোনো নিরাপরাধ ব্যক্তি হয়রানির শিকার না হয়, সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও বেশি সচেতন থাকতে হবে।
মন্তব্য করুন