প্রতিদিনই মৃত্যুর অশনি বার্তা বয়ে আনছে খুলনার নদ-নদীতে ভেসে অজ্ঞাত মরদেহগুলো। জলের বুক চিরে গত এক বছরে অর্ধশতাধিক মরদেহ উদ্ধার হয়েছে খুলনায়। আর প্রতিটি নিথর দেহ শহরবাসীর হৃদয়ে জাগিয়ে তুলছে ভয় আর অস্থিরতার তরঙ্গ। রহস্যে আচ্ছন্ন এ মৃত্যু মিছিলের ছায়া এখন ঢেকে দিচ্ছে পুরো নগরীর নিঃশ্বাস।
সম্প্রতি খুলনায় উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে নদ-নদীতে মরদেহ উদ্ধারের ঘটনা। গত এক বছরে নদী থেকে অন্তত ৫০টি মরদেহ উদ্ধার করেছে নৌ-পুলিশ। অজ্ঞাত এসব মরদেহের পরিচয় শনাক্ত করতে ব্যর্থ পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো, যা বাড়াচ্ছে জনমনে আতঙ্ক। ঘন ঘন মরদেহ উদ্ধারের এ প্রবণতায় স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এমন পরিস্থিতি সামাল দিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা আরও বাড়ানোর দাবি তুলেছেন স্থানীয়রা।
নৌ-পুলিশের তথ্য মতে, গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ৫০টিরও বেশি মরদেহ উদ্ধার হয়েছে। এর মধ্যে ৩০টির পরিচয় শনাক্ত হলেও ২০টি মরদেহের পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। ২০২৪ সালের আগস্টে ৫টি, সেপ্টেম্বরে ৪টি, অক্টোবরে ১টি, নভেম্বরে ৩টি এবং ডিসেম্বরে ২টি লাশ উদ্ধার হয়।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চে উদ্ধার হওয়া ৭টি লাশের সব কয়টির পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়। তবে এপ্রিলে উদ্ধার হওয়া ৩টির মধ্যে ২টি, মে মাসে ৬টির মধ্যে ৪টি, জুনে ৬টির মধ্যে ২টি, জুলাইয়ে ৩টির মধ্যে ১টি এবং আগস্টে ৮টির মধ্যে ৩টি মরদেহের পরিচয় মেলেনি। চলতি সেপ্টেম্বরের শুরুতেই বটিয়াঘাটা কাজীবাছা নদী ও রূপসা নদী থেকে উদ্ধার হওয়া দুটি লাশেরও পরিচয় মেলেনি।
এ দিকে মঙ্গলবার (২৩ সেপ্টেম্বর) খুলনা শিপইয়ার্ড ১ নম্বর জেটির পাশে নদীর তীরে ভাসমান অবস্থায় এক ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। তবে নিহত ব্যক্তির পরিচয় এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। রহস্য উদঘাটনে পুলিশ কাজ শুরু করেছে।
এ বিষয়ে লবণচরা থানার ওসি হাওলাদার সানোয়ার মাসুম বলেন, একটি মরদেহ নদীতে ভেসে আসে। আমরা ঘটনাস্থল থেকে নৌ-পুলিশকে বিষয়টি জানিয়েছি। তারা মরদেহটি উদ্ধার করে পোস্টমর্টেমের জন্য খুলনা মেডিকেল মর্গে পাঠিয়েছে।
পুলিশ জানায়, উদ্ধার হওয়া প্রতিটি মরদেহই ছিল পচাগলা, আঙুলের টিস্যু পর্যন্ত নষ্ট। ফলে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করেও মিলছে না কোনো পরিচয়। বাধ্য হয়ে অধিকাংশ মরদেহই দাফন করা হচ্ছে ‘বেওয়ারিশ’ হিসেবে।
পুলিশ আরও জানায়, পচন ধরায় অধিকাংশ ব্যক্তির মুখ এবং আঙুল শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। পরে সিআইডি ও পিবিআই টিম তার ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে ঢাকায় পাঠায়। লাশের নাম-পরিচয় না পাওয়া গেলে মরদেহগুলো দাফন করে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদীতে লাশ ফেলার প্রবণতা কমাতে নৌ-পুলিশের টহল জোরদার করা, নদীপথে নজরদারি বাড়ানো এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো জরুরি। এ ছাড়া, স্থানীয় জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা এই সমস্যা মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
নৌ-পুলিশ খুলনা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এ অঞ্চলের আওতায় রয়েছে খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর ও সাতক্ষীরা জেলার নদ-নদী। এর মধ্যে খুলনার ভৈরব, রূপসা, কাজিবাছা, আঠারবেঁকী ও শিবসা নদী; বাগেরহাটের পশুর ও শ্যালা নদী; পিরোজপুরের সন্ধ্যা, কচা ও বলেশ্বর নদী এবং সাতক্ষীরার নওবেঁকীসহ একাধিক নদী থেকে এসব লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
নৌ-পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ৫০টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩২ জন পুরুষ, ৭ জন নারী এবং ১১ জন শিশু। লাশগুলোর মধ্যে রূপসা নদী থেকে ৪০ শতাংশ, ভৈরব নদী থেকে ৩০ শতাংশ, পশুর নদী থেকে ২০ শতাংশ এবং অন্যান্য নদী থেকে ১০ শতাংশ উদ্ধার হয়েছে।
খুলনার বিশিষ্ট নাগরিক নেতা অ্যাডভোকেট কুদরত-ই-খুদা বলেন, দেশে আইনশৃঙ্খলার অবনতি হয়েছে। রাজনৈতিক বা অন্য কোনো কারণে পুলিশ যথাযথভাবে কাজ করতে পারছে না। তাছাড়া রয়েছে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। এ সুযোগে এক শ্রেণির মানুষ শত্রুতা করছে। তারা অপরাধ করে পার পাবেন মনে করে। দেশের সার্বিক অবস্থা স্বাভাবিক রাখার জন্য প্রথমে প্রশাসনের সংস্কার এবং পরে তাদের মানবিক সংস্কারের প্রয়োজন।
খুলনা নৌপুলিশ সুপার ডা. মঞ্জুর মোর্শেদ বলেন, নদ-নদীতে লাশ ফেলা অপরাধীদের কাছে নিরাপদ কৌশল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। নৌকা বা ফেরি থেকে পড়ে অথবা গোসল করতে গিয়ে অনেকের মৃত্যু হয়। তবে অনেক ক্ষেত্রে হত্যার পর লাশ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।
তিনি আরও বলেন, স্থলভাগে লাশ ফেলার তুলনায় নদীতে ফেললে হত্যাকারীদের শনাক্ত করা কঠিন হয়। পানিতে দীর্ঘ সময় থাকার কারণে লাশের চেহারা বিকৃত হয়, জলজ প্রাণী দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং শরীরের টিস্যু নষ্ট হয়ে যায়। এতে ফিঙ্গারপ্রিন্ট বা অন্যান্য শনাক্তকরণ পদ্ধতি অকার্যকর হয়ে পড়ে। শুধু ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে পরিচয় নির্ণয় সম্ভব হয়, যা অনেক সময়সাপেক্ষ।
মন্তব্য করুন