‘মোরা ঝাড়ুদার, এই শহরকে রাতদিন পরিষ্কার রাখাই মোগ কাম। স্বামী ২ মাস ধইরা এক্সিডেন্ট (দুর্ঘটনায়) হইয়া বাসায় আছে। এর মধ্যে শুরু হচ্ছে শারদীয় দুর্গাপূজা। সবাই কেনাকাটা কইরা ফেলাইছে, মোগ কপালে এহনো নতুন পোশাক জোটেনাই। জোটবেই বা কেমনে মোগা তো এবার উৎসব ভাতাই দেয় নাই।’ আক্ষেপের সুরে কথাগুলো বলছিলেন বরিশাল সিটি করপোরেশনের (বিসিসি) মজুরিভিত্তিক ঝাড়ুদার হরিজন সম্প্রদায়ের নারী বুড়ি রানী। তিনি বরিশাল নগরীর আমির কুটির হরিজন কলোনির বাসিন্দা।
শুধু বুড়ি রানী নয়, এবার শারদীয় দুর্গাপূজায় হাঁসি-আনন্দ নেই বরিশাল সিটি করপোরেশনের সনাতন ধর্মের প্রায় ৪০০ মজুরিভিত্তিক কর্মচারীর পরিবারে। মাত্র তিন দিন আগেই তাদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, এবার দুর্গাপূজায় উৎসব ভাতা পাবেন না সনাতনী মজুরিভিত্তিক কর্মচারীরা। পূজা শুরুর মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে নগর কর্তৃপক্ষের এমন কথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে তাদের ঘাড়ে।
নগরভবন সূত্রে জানা গেছে, হিন্দু-হরিজন সম্প্রদায়ের প্রায় ৪০০ মজুরিভিত্তিক কর্মচারী কাজ করেন নগর ভবনের বিভিন্ন শাখায়। বেশিরভাগ শ্রমিক করেন রাস্তাঘাটে ময়লা-আবর্জনা পরিচ্ছন্নতার কাজ। ইতিপূর্বে দৈনিক মজুরি ৫০০ টাকার পাশাপাশি দুর্গাপূজায় উৎসব ভাতাও পেয়েছেন তারা। কিন্তু পূজা শুরুর মাত্র দু’দিন বাকি থাকলেও এবারই প্রথম উৎসব ভাতা পাচ্ছেন না সিটি করপোরেশনের মজুরিভিত্তিক কর্মচারীরা।
মজুরিভিত্তিক কর্মচারীরা জানিয়েছেন, এর আগে প্রতি বছর দুর্গাপূজায় উৎসব ভাতা পেতেন তারা। তাই বছরের এই দিনটির দিকে তাকিয়ে থাকেন তারা। বেতন-বোনাস মিলিয়ে মোটামুটি ভালো হতো তাদের পূজার উৎসব। কিন্তু এবারই প্রথম বোনাস পাচ্ছেন না তারা।
সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মী হরিজন সম্প্রদায়ের আরেক মজুরিভিত্তিক কর্মচারী সুমন দাস শুরমা বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে গত দুই মাস ধরে আমি শয্যাশায়ী। বাইরে যেতে পারি না। মাস শেষে যা মজুরি পাই তা দিয়ে সংসার চলে। ভাবছিলাম পূজার বোনাস পেলে স্ত্রী-সন্তানদের নতুন পোশাক কিনে দেব। কিন্তু তা আর হলো না। স্যাররা জানিয়ে দিয়েছেন এবার আর বোনাস দেবেন না। তার ওপর চলতি মাসের বেতনও আগামী মাস ছাড়া পাব না। তাই পূজার কোনো আয়োজন নেই আমার পরিবারে।’
আরেক পরিচ্ছন্নতাকর্মী পরেশ হালদার বলেন, ‘গত মঙ্গলবার সিও স্যারের (প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা) কাছে গেছিলাম। তিনি বলেছেন, এই বছর তোমাদের উৎসব ভাতা দেওয়া হবে না। পরিবারের সদস্যরা চেয়ে আছে। এখন কেমনে কী করব তা বুঝে উঠতে পারছি না।’
ভাতা বঞ্চিত মজুরিভিত্তিক শ্রমিকরা বলছেন, আগামী ২ অক্টোবর দুর্গাপূজার সরকারি ছুটি। তার আগে অন্তত মাসের বেতনটা পরিশোধ করা হোক।
বর্তমানে দেশের বাইরে অবস্থান করায় এ বিষয়ে বক্তব্য জানা যায়নি সিটি করপোরেশনের প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনার রায়হান কাওছারের। বিভাগীয় কমিশনারের সরকারি মোবাইল নম্বর কল করা হলে স্থানীয় সরকার পরিচালক আহসান হাবিব বলেন, ‘স্যার ছুটিতে দেশের বাইরে গেছেন।’
তবে দুর্গাপূজায় উৎসব ভাতা না দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন বরিশাল সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রেজাউল বারী। তিনি বলেন, ‘মজুরিভিত্তিক কর্মচারী নিয়োগে অর্থ মন্ত্রণালয়ের যে প্রজ্ঞাপন রয়েছে তাতে দৈনিক মজুরিভিত্তিক শ্রমিকদের উৎসব ভাতা দেওয়ার বিধান নেই। তবে ইতঃপূর্বে তাদের দৈনিক মজুরি কম থাকায় বছরে একটি করে উৎসব ভাতা দেওয়া হতো। এবার তাদের দৈনিক মজুরি ৫০০ টাকা থেকে সাড়ে ৭০০ টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। এ কারণে তাদের এখন থেকে আর উৎসব ভাতা দেওয়া হবে না। তাছাড়া বেতন বৃদ্ধির কারণে শ্রমিকদের প্রতি মাসে প্রায় সাত কোটি টাকা মজুরি দিতে হবে। এখন মাস শেষে কীভাবে আমরা বেতন পরিশোধ করবো তা নিয়ে চিন্তায় আছি।’
মন্তব্য করুন