বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলে ফের বেড়েছে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা। স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য বলছে, বিগত বছরের তুলনায় ৯ মাসে এ বিভাগে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। এ পর্যন্ত বরিশালে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ২৬৮ জনে। গত বছর যা ছিল ৮ হাজার ৭৭৩ জন।
তবে আক্রান্ত বাড়লেও ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা কমেছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। চলতি বছর এখন পর্যন্ত এ বিভাগে মৃত্যু হয়েছে ২৯ জনের, গত বছর মৃত্যু হয়েছিল ৬৪ জনের। গত বছর থেকে চলতি বছর আক্রান্ত ও মৃত্যুতে শীর্ষে বরগুনা জেলা।
স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির কারণে এ বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হার কমেছে। আক্রান্তদের অভিযোগ, জেলা-উপজেলাগুলোয় মশা নিধনে কার্যকরী ব্যবস্থা না থাকায় রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বছরের শুরু থেকেই বরিশাল বিভাগে ডেঙ্গু আক্রান্তের হার বাড়তে থাকে। দক্ষিণাঞ্চলের সর্ববৃহৎ বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতালে বছরজুড়ে ১ হাজার ৪৬০ ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১৭ জনের। গতকাল শনিবার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন ৮০ রোগী। এদের মধ্যে বরিশাল জেলার বাইরের রোগীর সংখ্যাই বেশি।
শেবাচিম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ডেঙ্গু রোগী বরগুনার ডউয়াতলা গ্রামের বাসিন্দা তরিকুল ইসলাম বলেন, স্থানীয় বাজারে ব্যবসা করেন তিনি। প্রথমে জ্বরে আক্রান্ত হন এবং পরে ডাক্তার দেখিয়ে পরীক্ষা করলে জানতে পারেন, তার ডেঙ্গু হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা যারা গ্রামে থাকি, সেখানে মশা নিধনের কার্যকরী কোনো ব্যবস্থা নেই। গ্রামে মশা থাকলেও কোনো ওষুধ ছিটানো হয় না। তাই আক্রান্তও বেশি হয়।
গার্মেন্টসকর্মী পটুয়াখালীর মামুন সিকদার বলেন, ঢাকার সাভারে জ্বর আসে। এক সপ্তাহ ঢাকায় চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খেয়েছেন। সুস্থ না হওয়ায় বাড়ি এসে পরীক্ষা করে জানতে পারেন ডেঙ্গু হয়েছে। শেবাচিম হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে এখন অনেকটা সুস্থ।
শেবাচিম হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. একেএম মশিউল মুনীর কালবেলাকে বলেন, ডেঙ্গুতে মৃত্যু নিয়ে আমরা সতর্ক থাকি। শেবাচিমে বরিশাল বিভাগের বাইরেরও রোগী আসে। তবে অধিকাংশ রোগী আসছে বরগুনা, পাথরঘাটা, পিরোজপুর এবং পটুয়াখালী থেকে। এরা একদম শেষ পর্যায়ে আসে। এদের ফুসফুসে পানি জমাসহ বিভিন্ন সমস্যা থাকে। তাদের আইসিইউ সাপোর্ট দিয়েও ইমপ্রুভ করা যায় না। এরপরও আমরা রোগীদের ভালো মানের চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করছি।
বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০২৪ সালে বরিশাল বিভাগে ৮ হাজার ৭৭৩ ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী সরকারি হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৬৪ জনের। ওই বছরও ডেঙ্গুর প্রকোপ ছিল বরগুনা জেলায়।
চলতি বছর সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ১৩ হাজার ২৬৮ জন। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ২৯ জনের। চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ৯ হাজার ৮৬৮ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে। এ বছর মৃত্যু হওয়া ২৯ জনের মধ্যে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে গত ২৩ দিনে। চলতি মাসে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে ধারণা স্বাস্থ্য বিভাগের।
ডেঙ্গুর হটস্পট বরগুনা : গত বছরের মতো এ বছরও বিভাগের মধ্যে আক্রান্ত এবং মৃত্যুর দিক দিয়ে শীর্ষে বরগুনা জেলা। এ জেলায় এ পর্যন্ত ৭ হাজার ১৯৫ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। এ জেলার হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসাধীন মৃত্যু হয়েছে ১১ জনের। বর্তমানে জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে ১৬১ জন রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। শেবাচিম হাসপাতালে মৃত্যু হওয়া অধিকাংশ রোগীর বাড়িও বরগুনায়।
এ ছাড়া দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা পটুয়াখালী জেলায় এখন পর্যন্ত ২ হাজার ২০৫ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। তবে এ জেলায় এখন পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে একজনের। বর্তমানে চিকিৎসা নিচ্ছেন ৯৬ জন।
শেবাচিম হাসপাতাল ছাড়া বরিশাল জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে মোট চিকিৎসা নিয়েছেন ৯৪৭ জন। বর্তমানে চিকিৎসা নিচ্ছেন ৪৪ জন। ভোলা জেলায় মোট চিকিৎসা নিয়েছেন ৩৫২ জন, বর্তমানে ভর্তি ২২, পিরোজপুরে চিকিৎসা নিয়েছেন ৭৯১, ভর্তি ২৫ জন এবং ঝালকাঠি জেলায় চিকিৎসা নিয়েছেন সর্বনিম্ন ৩১৮ জন। এ জেলায় বর্তমানে চিকিৎসা নিচ্ছেন ১৩ জন।
বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. শ্যামল কৃষ্ণ মণ্ডল কালবেলাকে বলেন, বরগুনা জেলাকে ডেঙ্গুর হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এখানে ঢাকার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের টিম এসে ডেঙ্গুর ওপর সার্ভে করে গেছে। তাতে দেখা গেছে, বৃষ্টির পর জমে থাকা পানি এবং মানুষের ঘরে জমানো পানিতে এডিস মাশার বিস্তার ঘটছে। তা ছাড়া এ জেলার মানুষের মধ্যে কিছু সচেতনতার অভাব রয়েছে। আক্রান্ত হলেও যথাযথ চিকিৎসা নিচ্ছেন না। আবার আক্রান্তরা স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। এক ঘরে একাধিক সদস্য আক্রান্তের তথ্যও রয়েছে।
তিনি বলেন, প্রতি বছর সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের দিকে ডেঙ্গু রোগী বেশি হয়। এবার জুন-জুলাই মাসেই বরগুনা জেলায় প্রকোপ দেখা দিয়েছে। যার ফলে আক্রান্তের সংখ্যাটা অনেক বেশি। গত বছরের চেয়ে এ বছর মৃত্যুর হার কম, তার কারণ হতে পারে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের চিকিৎসকরা শতভাগ চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম ও ওষুধ আমাদের রয়েছে। ডেঙ্গু সংক্রমণ রোধে সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বান জানান তিনি।
মন্তব্য করুন