রাজশাহী অঞ্চলে ভয়াবহভাবে বাড়ছে সাপে কাটা রোগীর সংখ্যা। চলতি বছরে এখন পর্যন্ত এক হাজারেরও বেশি মানুষ সাপের কামড়ে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। মারা গেছেন ৩৮ জন। সবচেয়ে আতঙ্কের নাম হয়ে উঠেছে ‘রাসেলস ভাইপার’। এই সাপের আক্রমণ গত আট বছরে বেড়েছে চারগুণ।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর মে থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়টাতেই সাপে কাটা রোগীর সংখ্যা বেশি থাকে। চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ১৬৭ রোগী। এর মধ্যে ২৪৭ জন বিষধর সাপের কামড়ে আক্রান্ত। অবিষধর সাপে কামড়েছে ৯২০ জনকে।
গত বছর রামেকে ভর্তি হয়েছিলেন ১ হাজার ৩৭০ সাপে কাটা রোগী। এর মধ্যে ৩১৪ জন ছিলেন বিষধর সাপের কামড়ে আক্রান্ত। মারা যান ৪০ জন।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, মৃত্যুর বেশির ভাগ ঘটনাই ঘটেছে রাসেলস ভাইপার, কেউটে ও গোখরার কামড়ে। শুধু রাসেলস ভাইপারের কামড়ে প্রাণ হারিয়েছেন ১০ জন।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৮ সালে রাসেলস ভাইপারের কামড়ে ভর্তি হয়েছিলেন ২১ জন। ২০১৯ সালে ২৮ জন, ২০২০ সালে ৩৫ জন, ২০২১ সালে ৩৭ জন, ২০২২ সালে ৩১ জন, ২০২৩ সালে ৫০ জন এবং ২০২৪ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৮৬ জনে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভর্তি হয়েছেন ৫৩ জন। এই সাপের কামড়ে মৃত্যুহার প্রায় ২৩ শতাংশ।
সাপে কাটা রোগীর সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকায় রামেকে চালু হতে যাচ্ছে ১২ শয্যার একটি বিশেষায়িত ওয়ার্ড। চলতি মাসেই ওয়ার্ডটি চালু হবে। সেখানে থাকবে সার্বক্ষণিক চিকিৎসক ও নার্স এবং পর্যাপ্ত অ্যান্টিভেনম। হাসপাতালের ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের সম্প্রসারিত অংশে তৈরি হচ্ছে নতুন এই ইউনিট। দায়িত্বে থাকবেন মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আবু শাহীন মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান।
তিনি বলেন, ওয়ার্ডের জন্য ৮ নার্স নির্বাচিত হয়েছেন। চিকিৎসক ও নার্সদের ‘ন্যাশনাল স্নেকবাইট গাইড’ অনুযায়ী প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এতে রোগীরা দ্রুত ও সমন্বিত চিকিৎসা পাবেন।
চিকিৎসক আবু শাহীন বলেন, বিশেষায়িত ওয়ার্ড চালু হলে মৃত্যুহার অনেকটা কমে আসবে। এখন মানুষ সাপের ছবি তুলে শনাক্ত করতে পারছেন, ফলে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা সম্ভব হচ্ছে।
চিকিৎসকরা পরামর্শ দিয়েছেন— রাতে মশারি টাঙিয়ে ঘুমানো, মাঠে কাজের সময় গামবুট পরা, চলাফেরায় টর্চলাইট ও লাঠি ব্যবহার করা এবং আবর্জনা পরিষ্কারের সময় সতর্ক থাকা।
চারঘাট উপজেলার কৃষক আমিরুল ইসলাম বলেন, ধানক্ষেতে কাজ করার সময় রাসেলস ভাইপার কামড় দেয়। দ্রুত হাসপাতালে আনা হয়, তাই বেঁচে গেছি। বাঘা উপজেলার গৃহবধূ রহিমা খাতুন বলেন, রাতে বিছানায় কেউটে সাপে কামড় দেয়। হাসপাতালে দ্রুত আনার কারণে বেঁচে আছি। তবে আমাদের গ্রামে আগেও দুজন মারা গেছেন।
কলেজছাত্র রাজিব হোসেন বলেন, নদীর ধারে বসে থাকার সময় হঠাৎ সাপ কামড় দেয়। হাসপাতালে এনে চিকিৎসা পেয়ে সুস্থ হই। এলাকায় প্রায়ই রাসেলস ভাইপারের উপদ্রব দেখা যায়।
রামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফএম শামীম আহমেদ বলেন, সারা দেশের সাপে কাটা রোগীর অর্ধেকই রাজশাহী মেডিকেলে চিকিৎসা নেন। কিন্তু অ্যান্টিভেনম সংকট রয়েছে। কোম্পানিগুলো থেকে ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে না, ধার করে আনতে হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, রোগীর সংখ্যা বাড়ায় আমরা বিশেষায়িত ওয়ার্ড চালু করছি। এখানে সুস্থতার হার অনেক ভালো। তবে অনেক রোগী ওঝার কাছে গিয়ে দেরিতে আসে— ফলেই মৃত্যু বাড়ছে। আমরা চেষ্টা করছি যেন সবাই দ্রুত ও সঠিক চিকিৎসা পায়।
মন্তব্য করুন