কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী সীমান্তের কালজানী নদী হয়ে নাগেশ্বরীর দুধকুমার নদে গত ২ দিন ধরে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ভেসে এসেছে কয়েক হাজার গাছের গুঁড়ি। এসব গাছের গুঁড়ি বাকল ও শিকড়বিহীন হওয়ায় এবং দেখতে লাল বর্ণের হওয়ায় উৎসুক জনতা ‘রক্ত চন্দন’ ভেবে ভিড় করছেন। কেউ কেউ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নদীর স্রোতকে উপেক্ষা করে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে এসব গাছের গুঁড়ি নিয়ে এসে তীরে জমিয়ে সেগুলো ‘চন্দন কাঠ’ হিসেবে বিক্রি করছেন। অনেকেই আবার না বুঝেই সেগুলো কিনছেন।
এদিকে উৎসুক জনতার এমন কাণ্ড দেখে স্থানীয়রা এসব কাঠের গুঁড়ি একেকটি ২০ থেকে ৩৫ হাজার দাম হাঁকাচ্ছেন। কেউ কেউ ১ লাখ ২০ হাজার পর্যন্ত দাম চাচ্ছেন।
জানা গেছে, জেলার চিলমারীর ব্রহ্মপুত্র নদে উজান থেকে ভেসে আসা হাজার হাজার গাছের গুঁড়ি, বিভিন্ন উপায়ে নদী তীরবর্তী এলাকার বাসিন্দারা সংগ্রহ করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখছেন। গত ৬ অক্টোব সকাল থেকে ব্রহ্মপুত্র নদে গাছের গুঁড়ি ভাসতে দেখেন স্থানীয়রা। উপজেলার রানীগঞ্জ ইউনিয়নের ফকিরেরহাট ঘাট এলাকা থেকে শুরু করে রমনা মডেল ইউনিয়নের জোড়গাছ ঘাট পর্যন্ত কয়েক কিলোমিটার তীর এলাকাজুড়ে হাজার হাজার গাছের গুঁড়ি নদী থেকে তুলছেন স্থানীয়রা।
চিলমারীর রমনা ইউনিয়নের বাসিন্দা মজিবর রহমান বলেন, স্রোতের কারণে গাছগুলো উজান থেকে ভেসে আসছে, তাই আমরা তুলে নিয়ে যাচ্ছি। হালিমা বেগম নামে এক নারী জানান, সকালে উঠে দেখি এইসব গাছের ডাল ভেসে আসছে। তাই বউ ছেলে-মেয়েসহ খড়ি তুলছি। এগুলো দিয়ে রান্নার কাজ ছাড়া অন্য কিছু হবে না।
চিলমারী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, নদীতে শুধু গাছ আর গাছ। মানুষ নৌকা দিয়ে গাছ টেনে আনছে। তবে জেলা বন বিভাগ বলছে, মানুষজন না বুঝেই এসব কাঠের গুঁড়ি শ্বেত বা রক্ত চন্দন ভেবে বেচাকেনা করছেন।
এদিকে গাছের গুঁড়ি উঠাতে গিয়ে রোববার (৫ অক্টোবর) সকালে জেলার নাগেশ্বরী উপজেলার বেরুবাড়ী ইউনিয়নের খেলারভিটা, খামার নকুলা গ্রামের আমজাদ হোসেনের ছেলে মনছুর আলী (৪০) পানিতে ডুবে নিখোঁজ হয়েছেন।
বুধবার (৮ অক্টোবর) সরেজমিন দেখা যায়, ভুটান হয়ে ভারত থেকে ভেসে আসা এসব গাছের গুঁড়ি সীমান্তে আর ভেসে আসতে দেখা যায়নি। আগের ২ দিন ভেসে আসা কাঠের গুঁড়িগুলো মূল্যবান ভেবে কালজানী ও দুধকুমার নদের পাড়ে স্তূপ করে রেখেছেন স্থানীয় উৎসুক জনতা। এসব কাঠের গুঁড়ি একেকটির আকার ও পরিমাপ ভেদে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকায় বেচাকেনা হচ্ছে। আর যেসব কাঠের গুঁড়ি নষ্ট হয়ে গেছে সেগুলো জ্বালানি হিসেবে কেউ কেউ বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন আবার অনেকেই সেগুলো মণ হিসেবে বিক্রি করছেন।
এর আগে, উপজেলার নুনখাওয়া ইউনিয়নের নুনখাওয়া, বেরুবাড়ি ইউনিয়নের খেলারভিটা, রায়গঞ্জের বড়বাড়ী, বামনডাঙ্গার আয়নালের ঘাট, আদর্শ বাজার, মুড়িয়া, পাচমাতা, তেলিয়ানী, বেরুবাড়ী ইউনিয়নের ইসলামপুর থেকে খেলারভিটা হয়ে কালীগঞ্জ ইউনিয়নের সিএন্ডবি ঘাট পর্যন্ত দুধকুমারের দুই তীরে অসংখ্য মানুষ কেউ নৌকা নিয়ে, কেউ সাঁতরে সে গাছগুলো ধরে স্তূপ করে রাখছেন নদের কিনারে।
স্থানীয়রা জানান, কয়েক হাজার ভেসে আসা এসব গাছের গুঁড়ি জ্বালানি হিসেবে এর বাজার মূল্য কয়েক কোটি টাকা। নাগেশ্বরীর বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের ছিটমাইলানী গ্রামের বাসিন্দা মো. সিরাজ বলেন, ‘আমি গতকাল রাইত থেকে পরিবার নিয়ে কাঠের গুঁড়ি গুল্যা জমাইছি। প্রায় ৫০০ মণ হবে আমার কাঠ। পরিবারের জন্য কিছু রেখে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার বিক্রি করব।’
পাশের রায়গঞ্জ ইউনিয়নের দামাল গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল মোতালেব বলেন, চারজন মিলে ৫০ ফুটের এই লাল গাছটা উঠায়ছি। আরও ৬ জন সাহায্য করছে। এটা রক্ত চন্দনের গাছ। ১ লাখ ২০ হাজার হলে বিক্রি করব।
কাঠ ব্যবসায়ী নয়ন মিয়া বলেন, চন্দন কাঠ ভেসে আসার খবর পুরোটাই গুজব। গত তিনদিন ধরে ভেসে আসা কাঠের গুড়ি কিনলাম। আমার জানা মতে রক্ত চন্দন কাঠ কোথাও পাওয়া যায় নাই। কেউ না বুঝে রক্ত চন্দন কাঠ বললে সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার।
স মিল ব্যবসায়ী তাজুল ইসলাম বলেন, মানুষ হুজগে এসব বলছে। রক্ত চন্দন গাছের মূল্য অনেক বেশি। পানিতে ভিজলে অনেক গাছের কালার লাল হতেই পারে, তাই বলে চন্দন গাছ এগুলো মনে হয় না। আর এগুলো উজানে ভারত ও ভুটানে বেশি বৃষ্টির কারণে পানিতে ভেসে আসছে।
কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ও উদ্ভিদবিদ মীর্জা নাসির উদ্দিন বলেন, সার কাঠে প্রচুর ট্যানিন এবং ফেনলিক যৌগ থাকে। যখন কাঠ পানিতে ভিজে, তখন এই যৌগগুলো পানিতে দ্রবীভূত হয়ে বের হয়। ট্যানিন অক্সিজেনের সংস্পর্শে এসে অক্সিডেশন ঘটায় এবং লালচে-বাদামি রং তৈরি করে। প্রকৃতপক্ষে এগুলো চন্দন কাঠ নয়।
জেলা বন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. সাদিকুর রহমান কালবেলাকে বলেন, সরেজমিন এসব গাছের গুঁড়ি দেখেছি। দীর্ঘদিন এসব পানিতে থাকায় লাল বর্ণ ধারণ করেছে। প্রকৃতপক্ষে শ্বেত বা রক্ত চন্দনের কোনো বিষয় নেই। লোকজন না বুঝেই এসব কিনছেন এবং বিক্রি করছেন। তবে এগুলো কোনো চোরাচালান গাছ নয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ সৃষ্ট বন্যায় গাছের গুঁড়িগুলো পানির তোড়ে ভেসে এসেছে।
নাগেশ্বরী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সিব্বির আহমেদ জানান, উজান থেকে পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে বিশাল পরিমাণ কাঠের গুঁড়ি ভেসে আসছে। এই কাঠ ধরতে গিয়ে স্থানীয়রা বিপদের সম্মুখীন হচ্ছে। বিশেষ করে কাঠের সঙ্গে সাপের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। তাই তিনি সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।
কুড়িগ্রাম জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ফিরুজুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, বন্যা হলে উজান থেকে গাছের গুঁড়ি কাঠ বাঁশ ভেসে আসতে দেখা যায়। তবে এগুলো চোরাচালান গাছ নয়। দুর্যোগের কারণে এগুলো ঘটে থাকে। তথ্য মতে রক্ত চন্দন কাঠ ভেসে আসার ঘটনায় বিভ্রান্ত হওয়ার সুযোগ নেই।
মন্তব্য করুন