বশির হোসেন, খুলনা ব্যুরো
প্রকাশ : ২৪ অক্টোবর ২০২৫, ১০:১২ এএম
অনলাইন সংস্করণ

প্রতিশ্রুতির গল্লামারী সেতু এখন দুর্ভোগের প্রতীক

সেতুর নির্মাণ কাজ বন্ধ থাকায় প্রতিদিনই দুর্ঘটনার পাশাপাশি দুইপাড়ে সৃষ্টি হচ্ছে তীব্র যানজট। ছবি : কালবেলা
সেতুর নির্মাণ কাজ বন্ধ থাকায় প্রতিদিনই দুর্ঘটনার পাশাপাশি দুইপাড়ে সৃষ্টি হচ্ছে তীব্র যানজট। ছবি : কালবেলা

খুলনা শহরের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশদ্বার গল্লামারী সেতু। কোটি কোটি টাকা খরচ করে অপরিকল্পিত সেতু নির্মাণ ও ভেঙে ফেলে আবার পুনরায় নির্মাণে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন খুলনার স্থানীয় বাসিন্দা ও যাত্রীরা। নির্মাণকাজ বন্ধ থাকায় পাশের একটি পুরোনো ঝুঁকিপূর্ণ সেতু দিয়েই প্রতিদিন পারাপার হচ্ছে শত শত বাস, ট্রাক, ইজিবাইক ও পথচারী।

এতে প্রতিদিনই দুর্ঘটনার পাশাপাশি দুই পাড়ে সৃষ্টি হচ্ছে তীব্র যানজট। নির্ধারিত সময়ে মাত্র ১৯ শতাংশ কাজ শেষ হওয়ার পর এখন পর্যন্ত কখনও বন্ধ থাকছে আবার কখন কাজ চলছে কচ্ছপ গতিতে। ফলে প্রতিশ্রুতির সেতু আজ দুর্ভোগের প্রতীকে পরিণত হওয়ায় নগরবাসীর মধ্যে চরম ক্ষোভ আর হতাশা বিরাজ করছে।

জানা যায়, মাত্র সাত বছর আগে ২০১৬ সালে খুলনার সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশদ্বার ময়ূর নদের ওপর ৭ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছিল অপরিকল্পিত সেতুটি। নির্মাণে পানির স্তর থেকে সেতুটির উচ্চতার পরিমাপ ঠিক রাখা হয়নি। যে কারণে নদীতে নৌকা চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে সাত কোটি টাকা গচ্চা দিয়ে সেতুটি ভেঙে সেখানেই ৬৫ কোটি টাকা বরাদ্দে নতুন দৃষ্টিনন্দন আর্চ সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ২০২৩ সালের ১০ অক্টোবর সেতুটি নির্মাণের কাজ শুরু হয়। চলতি বছরের ৩০ মার্চ কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও নির্ধারিত সময়ে কাজ হয়েছে মাত্র ১৯ শতাংশ।

সরেজমিনে দেখা যায়, গল্লামারী সেতুর কাজের দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। সেতুর দুই পাড়ে ৭০-৮০ টন স্টিল ভিম ও হ্যাঙ্গার বার রাখা রয়েছে। সিকিউরিটি গার্ডের লোকজন সেগুলো পাহারা দিয়ে রাখছেন। ঠিকাদার ও সড়ক বিভাগের কিছু কর্মকর্তা সেখানে এসে মাপামাপি করছেন ও ঘুরে যাচ্ছেন। পাশের সেতুর মাঝে বাঁশ দিয়ে ডিভাইডার তৈরি করে আসা যাওয়া করছেন সাধারণ মানুষ। প্রতিদিন তীব্র যানজট ডিঙিয়ে সাধারণ মানুষকে যাতায়াত করতে হচ্ছে। সেতুর দুই পাড়ে ভোগান্তি নিয়ে চলাচল করছে সাধারণ মানুষ।

নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) এর খুলনা মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবুর রহমান মুন্না কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা কিছুদিন আগেও সড়ক বিভাগের সঙ্গে এই সেতুর বিষয়ে বৈঠক করেছি। আমাদের কাছে মনে হয়েছে এই অযোগ্য ঠিকাদারের প্রতি সড়ক বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্তদের কোনো ব্যক্তিগত সম্পর্ক আছে। কারণ, তা না হলে তারা ঠিকাদারের প্রতি জামাইসুলভ আচরণ করছে। আমাদের দাবি নিয়ে আমরা অচিরেই কঠোর আন্দোলনে যাব। কারণ অতি গুরুত্বপূর্ণ এই সেতু নির্মাণে টালবাহানার কারণে খুলনাবাসী সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েছে।’

সূত্র বলছে, গল্লামারী সেতু এবং সংযোগ সড়ক নির্মাণের জন্য সড়ক বিভাগের সঙ্গে ঠিকাদারের চুক্তি মূল্য ছিল ৬৭ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। গতবছর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের আগে বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে সেতুর নির্মাণ ব্যয় ২০ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ১৪ কোটি টাকা বৃদ্ধির চেষ্টা করছিল ঠিকাদার। ওই সময় তাদের বাড়তি টাকার বিষয়ে আশ্বাসও দিয়েছিলেন সাবেক এমপি শেখ সালাহ উদ্দিন জুয়েলসহ আওয়ামী লীগ নেতারা। কিন্তু অভ্যুত্থানের পর নেতারা পালিয়ে যান, সড়ক বিভাগেও ব্যাপক রদবদল করা হয়। সড়ক বিভাগের নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলীরা সব ধরনের বাড়তি ব্যয়ের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন।

সড়ক বিভাগ থেকে জানা গেছে, নগরীর গল্লামারী মোড়ে ময়ূর নদের ওপর পাশাপাশি দুটি সেতু হবে। ৬৮ দশমিক ৭ মিটার লম্বা ও ২৩ মিটার প্রশস্ত সেতু দুটির মূল অবকাঠামো হবে স্টিলের। দেখতে অনেকটা রাজধানীর হাতিরঝিলের আদলে নির্মাণাধীন সেতু দুটি নদী থেকে ৪ মিটার উঁচু হবে। সেতু নির্মাণের জন্য ২০২৩ সালের ১ অক্টোবর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিংকে (এনডিই) কার্যাদেশ দেয় সড়ক বিভাগ। চুক্তির আওতায় স্টিলের দুটি সেতু এবং সেতুতে যানবাহন ও পথচারীদের ওঠানামার জন্য দুই পাশে প্রায় ৭৫০ মিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণ করতে হবে। ২০২৩ সালের ৮ অক্টোবর পুরাতন সেতুটি ভাঙার কাজ শুরু করে ঠিকাদার। ওই বছরই নতুন সেতুর কাজ শুরু হয়। কিন্তু গতবছর আগস্টের পর থেকে দৃশ্যমান সব কাজ থমকে গেছে।

সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, নদীর পাড়ে পাইলিংয়ের জন্য সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়েছে রিং। মরিচা ধরেছে রডে। সেতুটি দাঁড় করাতে দুটি অ্যাবটমেন্টের (কংক্রিটের স্তর) মধ্যে দেখা মেলে একটির। সংযোগ সড়ক নির্মাণের কোনো তৎপরতা নেই। বর্তমানে ২১ ফুট প্রশস্ত একটি সেতু দিয়ে প্রতিদিন ১৫/২০ হাজার যানবাহন চলাচল করছে। এতে সেতুর দুই পাশেই তীব্র যানজট তৈরি হচ্ছে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ফউজিয়া ফারিয়া জেবা কালবেলাকে বলেন, ‘দিনে অন্তত একবার কখনও দুইবার এই সেতু পার হতে হয়। দুইপাড়ে শত শত যানবাহনের তীব্র জটের কারণে ভার্সিটির গেট থেকে হেঁটেই পুরো সেতু এলাকা পার হতে হয়। ফলে এতে একদিকে ভয়াবহ দুর্ঘটনার ঝুঁকি অন্যদিকে প্রতিদিনই অনেক সময় নষ্ট হয়। সঠিক সময়ে ভার্সিটিতে যাওয়া বা বাসায় ফেরা সম্ভব হয় না। এই নির্মাণ প্রকল্প দেখলে বোঝাই যায় না খুলনায় দায়িত্বশীল কোনো ব্যক্তি আছে।’

তবে ‘সেতুর কাজ বন্ধ নেই’ বলে দাবি করেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রকল্প প্রকৌশলী সেলিম রেজা। তিনি বলেন, ‘৬৪টি পাইলের মধ্যে ৩২টি আর চারটি পাইল ক্যাপের মধ্যে দুটির কাজ শেষ হয়েছে। গত বছর থেকে প্রকল্প ইয়ার্ডে স্টিলের অবকাঠামোর কাজ চলছে। নকশা পেতে দেরি হওয়ায় কাজে কিছুটা ধীরগতি ছিল। কাজ শেষ হলে সেটি কংক্রিটের কাঠামোর ওপর স্থাপন করা হবে।’

সড়ক ও জনপথের নির্বাহী প্রকৌশলী তাজিমুল হক কালবেলাকে বলেন, ‘গত বছরের আগস্টের পর থেকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কিছু অভ্যন্তরীণ সমস্যায় কাজে ধীরগতি এসেছে। প্রতিষ্ঠানকে আমরা বারবার তাগাদা দিচ্ছি। ঠিকাদার ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব করলেও আমরা তা নাকচ করে দিয়েছি। আবার নকশায় কিছুটা পরিবর্তন এলেও উল্লেখযোগ্য ব্যয় বৃদ্ধি পাবে না। ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত সময় বৃদ্ধি করা হয়েছে।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

দাঁড়িয়ে থাকা বাসে ধাক্কা, নিহত ২

শিল্পকলায় আসছে নোবেলজয়ী নাট্যকারের ‘ডিজায়ার আন্ডার দ্য এলমস’

দেড় বছর ধরে অনুপস্থিত, নিয়মিত বেতন তুলছেন স্বাস্থ্যকর্মী

বিএনপি নেতা নুরুল আমিনের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার

যুদ্ধবিরতির পরও গাজায় ক্ষুধার কষ্ট কমেনি : ডব্লিউএইচও

মালয়েশিয়ায় প্রবাসীকে হত্যা, ৪ বাংলাদেশিসহ আটক ৬

ফোনের ইন্টারনেট স্লো, সহজ ৯ কৌশলে হুহু করে বাড়বে স্পিড 

জন্মদিন যেভাবে উদযাপন করলেন পরী

এই সীমান্তের ৭০ শতাংশ বাসিন্দা মাদক ও চোরাচালানে জড়িত 

জাজিরায় কালবেলার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপিত

১০

তারুণ্যের ভাবনায় আগামীর নতুন বাংলাদেশ

১১

টি-টোয়েন্টি সিরিজের আগে উইন্ডিজ দলে পরিবর্তন

১২

দয়া করে পাগলাটে যুদ্ধ শুরু করবেন না, আমেরিকাকে মাদুরো

১৩

প্রধান উপদেষ্টার সৌদি সফর বাতিল

১৪

শনিবার মধ্যরাতে শেষ হচ্ছে ইলিশ শিকারে নিষেধাজ্ঞা

১৫

বাংলাদেশ দলে কে নেয় সিদ্ধান্ত? প্রশ্নের জবাবে মুখ খুললেন মিরাজ

১৬

দ্রুত চার্জিং কি ফোনের ব্যাটারি ক্ষতি করে, যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা

১৭

ভোটকেন্দ্রে আনসার সদস্যদের ভূমিকা কী থাকবে, জানালেন ডিজি

১৮

বাড়তি দামে মিলছে শীতের সবজি

১৯

সালমান শাহ হত্যা মামলার আসামিদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

২০
X