

বরিশালে চিকিৎসা অবহেলায় বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত অবসরপ্রাপ্ত ফ্লাইট সার্জেন্ট মুক্তিযোদ্ধা মো. রত্তন আলী শরিফের (৮২) মৃত্যুর অভিযোগ উছেঠে।
রোববার (২৮ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতালে মেডিসিন-১ ইউনিটের অধীনে পঞ্চম তলার ৫০০৩ কেবিনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
এর আগে, গত শনিবার (২৭ ডিসেম্বর) বিকালে বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যা নিয়ে তাকে শেবাচিম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। নিহত রত্তন আলী শরীফ বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার রাকুদিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা।
সন্তানদের অভিযোগ, বীরপ্রতীকের মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে থেকে কর্তব্যরত চিকিৎসকদের কয়েকবার ডাকা হলেও তারা কেবিনে গিয়ে চিকিৎসা দিতে রাজি হয়নি।
এদিকে চিকিৎসা অবহেলায় মৃত্যুর অভিযোগ তদন্তে ৬ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. মাহাবুবুর রহমানকে প্রধান করে গঠিত কমিটিতে বক্ষব্যাধি চিকিৎসক সহযোগী অধ্যাপক মাসুম আহমেদ, নিউরো মেডিসিনের সহযোগী অধ্যাপক ডা. অমিতাভ সরকার, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. আল মামুন, কিডনি বিভাগের প্রধান ডা. মোহাম্মদ আলী রুমি ও সহকারী অধ্যাপক ডা. মাহাদী হাসানকে সদস্য করা হয়েছে।
নিহতের মেয়ে তানজিলা আক্তার ইমু বলেন, ‘গত কয়েক দিন ধরে আমার বাবার ডায়াবেটিক ও প্রেশার নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যায়। এজন্য শনিবার বিকেলে বাবাকে শেবাচিম হাসপাতালের ভর্তি করি। ভর্তির পর কেবিনে এসে একজন শিক্ষানবিশ চিকিৎসক প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে যায়। পরের দিন রোববার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে একজন চিকিৎসক সেবা দিয়ে যান।’
তিনি আরও বলেন, দুপুরে আমার বাবার অক্সিজেন লেভেল কমে যায়। ডায়াবেটিক বৃদ্ধি পাওয়ায় অচেতন হয়ে যান। আমি কর্তব্যরত চিকিৎসকদের ডাকতে রুমে গেলে তারা কেবিনে গিয়ে চিকিৎসা দিতে অনীহা প্রকাশ করেন। তারা বলেন রোগীকে ওয়ার্ডে নিয়ে আসনে; নয়তো প্রাইভেট ক্লিনিকে নিয়ে যান।
তানজিলা বলেন, ‘এরপর রোগী আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন আবার কর্তব্যরত চিকিৎসককে ডাকতে গেলে আবারও সেই একই কথা বলেন দায়িত্বরত চিকিৎসকরা। তখন আমার এক বোন সিনিয়র সচিবকে ফোনে ধরিয়ে দিলে কেবিনে যান চিকিৎসক। কেবিনে গিয়ে দেখতে পায় আমার বাবার মারা গেছেন।’
নিহতের ছেলে শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমার বাবা দেশের জন্য যুদ্ধ করেও বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেন। এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার আমি সরকারের কাছে চাই।’
এ বিষয়ে শেবাচিম হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. এ কে এম মশিউল মুনীর বলেন, ‘ওই রোগীকে আমার তত্ত্বাবধানে কেবিনে ভর্তি করা হয়েছিল। চিকিৎসা অবহেলার বিষয়টি আমি নিশ্চিত না। এই ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। তদন্ত রিপোর্ট পেলে নিশ্চিতভাবে সঠিক কারণ বলা যাবে। এখানে কোনো চিকিৎসকের অবহেলা থাকলে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
বীরপ্রতীক রতন শরীফ ছিলেন একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর সৈনিক। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি অসীম সাহসিকতার সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বিমান বাহিনীতে কর্মরত অবস্থায় তিনি একাধিক দুঃসাহসিক অভিযানে অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব দেন। তার বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার তাকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করে, যা দেশের চতুর্থ সর্বোচ্চ সামরিক সম্মাননা।
বীরপ্রতীক রতন শরীফের জন্ম ১৯৪৮ সালের ২ জানুয়ারি বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার রাকুদিয়া গ্রামে। তিনি ১৯৬৩ সালে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯৭২ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের আগে তিনি পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। দেশমাতৃকার ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধের পাশাপাশি তিনি স্থানীয় পর্যায়ে জনপ্রতিনিধি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। দেহেরগতি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি এলাকায় উন্নয়ন ও জনসেবামূলক কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
মন্তব্য করুন