

দস্যু আতঙ্ক, প্রাণহানির ভয় ও অনিশ্চিত জীবনের কারণে সুন্দরবনের হাজারো বনজীবী পেশা পরিবর্তনে বাধ্য হচ্ছেন। একসময় এই বনজীবীরাই বনের গভীরে প্রবেশ করে মধু সংগ্রহ, মাছ ধরা, কাঁকড়া ও গোলপাতা আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে দস্যুদের উৎপাত, মুক্তিপণ আদায়, অপহরণের ঘটনায় বনের জীবিকা এখন হয়ে উঠেছে মৃত্যুঝুঁকিপূর্ণ। ফলে জীবনের নিরাপত্তা খুঁজে তারা ঝুঁকছে বিকল্প জীবিকার দিকে।
ছোটকাল থেকে সুন্দরবনে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন জেলে রায়হান শেখ কিন্তু বনদস্যু আতঙ্কে এখন আর বনে যান না তিনি। এলাকায় তেমন কর্মসংস্থান ও না থাকায় পরিবার নিয়ে পাড়ি জমিয়েছেন ঢাকা শহরে। মোবাইলে কথা হয় রায়হানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘জীবনের অর্ধেক সময় পার করেছি বনে মাছ ধরে। কিন্তু বনদস্যুর ভয়ে পেশা ছেড়ে ঢাকা শহরে একটি ফ্যাক্টরিতে শ্রমিকের কাজ করে কোনো মতে দিন পার করছি।’
গত সোমবার (২২ ডিসেম্বর) সকালে কয়রা বাসস্ট্যান্ডে ব্যাগ ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নিয়ে বসে থাকতে দেখা যায় বনজীবী সাফিদুল ইসলামকে। তিনি বলেন, ‘বনদস্যু আতঙ্কে এখন আর সুন্দরবনে মাছ-কাঁকড়া ধরতে যেতে পারি না। তাদের মুক্তিপণ দিয়ে যে টাকা ইনকাম হয় তাতে সংসার চালানো খুব কষ্ট সার্ধ হয়ে পড়ছে। এলাকায় তেমন কোনো কাজ কর্ম না থাকায় বাধ্য হয়ে নাড়াইলে দিন মজুরি হিসাবে ধান কাটার কাজে যাচ্ছি।’
আরেক বনজীবী আব্দুল জলিল (ছদ্মনাম) বলেন, ‘বনে গেলে জানি না বেঁচে ফিরব কি না। দস্যুরা বন্দুক ঠেকিয়ে টাকা চায়, না দিলে বেদম মারে, অপহরণ করে। একবার মুক্তিপণ দিতে হয়েছে, এরপর আর বনে যায় না। এখন ইট ভাটায় কাজ করি।’
সাম্প্রতিক সুন্দরবনে মাছ-কাঁকড়া আহরণ করতে যাওয়া ২ বনজীবী আ. সালাম ও আকবর আলী বনদস্যু জাহাঙ্গীর বাহিনীর হাতে আটক হন। শুধু আটক হয়ে শেষ হয়নি তাদের ওপর চালানো হয়েছে নির্মম নির্যাতন। তারা দুজনই চিকিৎসাধীন আছে।
নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে আকবার বলেন, ‘আমি আগে থেকে তাদের (বনদস্যুদের) চাওয়া অনুযায়ী টাকা পরিশোধ করে বনে গিয়েছি কিন্তু তারা আমাকে খুব মারধর করেছে। আমার মাজাসহ (কোমরে) সারা শরীরে লাঠি দিয়ে প্রচুর মেরেছে। একপর্যায়ে আমি হুঁশ (জ্ঞান) হারায়। পরে আর কিছু বলতে পারি না। পরবর্তী সময়ে আমি একদিন পরে আমার সহকর্মীরা আরও মুক্তিপণ দিয়ে আমাকে বাড়িতে নিয়ে আসে।’
একই বর্ণনা ভুক্তভোগী আ. সালামের। তিনি বলেন, ‘আমাকেও তাদের নৌকায় তুলে নিয়ে প্রচুর মেরেছে। একপর্যায়ে রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে তখন রাত ১টার দিকে তাদের (বনদস্যুদের) নৌকা থেকে পালিয়ে বনের গহিনে চলে আসি। শরীরে প্রচুর ব্যথার যন্ত্রণা আর পেটে ক্ষুধা নিয়ে রাতভর হেঁটে পরের দিন সন্ধ্যার একটু আগে একটি ফরেস্ট ক্যাম্পে এসে উঠি। কিন্তু তারা বনদস্যু ভেবে আমাকে আশ্রয় দিতে চায়নি, কিন্তু যখন তাদের ফোন দিয়ে বাড়িতে কথা বলিয়ে দিয়েছি তখন তারা আমাকে আশ্রয় দেয়। পরে তাদের সহযোগিতায় আমার বাড়ির লোকজন গিয়ে আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে।’
কয়রা কপোতাক্ষ কলেজের সাবেক অধ্যাপক আ.ব.ম আব্দুল মালেক বলেন, ‘দস্যু দমন ও নিরাপদ জীবিকার সুযোগ সৃষ্টি না হলে এই জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে আরও পিছিয়ে পড়বে। সরকার ও এনজিওদের সমন্বিত উদ্যোগে তাদের জন্য বিকল্প জীবিকার স্থায়ী ব্যবস্থা গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।’
সুন্দরবনসংলগ্ন কয়রা, দাকোপ ও শ্যামনগর এলাকায় ঘুরে বনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে ডাকাত-আতঙ্কের কথা জানা গেছে। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর জেল থেকে পালিয়ে অবৈধ অস্ত্র নিয়ে দস্যুরা আবারও সুন্দরবনে প্রবেশ করে বনজীবীদের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায় করছে। বনদস্যুরা গত এক বছরে শতাধিক জেলেকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করেছে। এ সময় টাকা আদায়ের জন্য তারা জিম্মি ব্যক্তিদের ওপর নির্যাতনও চালিয়েছে। এ কারণে অনেক জেলে এখন বনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পেশা বদলাতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। কেউ ভ্যান চালিয়ে, কেউ দিনমজুরি করে আবার কেউ ইট ভাটায় শ্রমিকের কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন।
ভুক্তভোগীরা জেলেরা জানান, আত্মসমর্পণকারী অনেক বাহিনী আবার দস্যুতায় ফিরেছে। বিশেষ করে পশ্চিম সুন্দরবনে মজনু বাহিনী, শরীফ বাহিনী, দয়াল বাহিনী, রবিউল বাহিনী, দুলাভাই বাহিনী, জাহাঙ্গীর বাহিনী, আবদুল্লাহ বাহিনী, মঞ্জুর বাহিনী, মাসুম বিল্লাহ ভাগনে বাহিনীর তৎপরতা বেড়েছে।
বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ থেকে কয়েক ধাপে ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত সুন্দরবনের ৩২টি দস্যু বাহিনীর ৩২৮ জন দস্যু ৪৬২টি অস্ত্র ও ২২ হাজার ৫০৪ গোলাবারুদসহ আত্মসমর্পণ করেছিলেন। পরে ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত ঘোষণা করা হয়।
আরও জানা যায়, বনদস্যুতার উৎপাতে জেলেরা আগের মতো বনে মাছ-কাঁকড়া ধরতে যাচ্ছে না। বদলাচ্ছে পেশা যে কারণে বন থেকে সরকারের যে রাজস্ব আদায় হতো তা অর্ধেকের ও কমে নেমে এসেছে। গত ১ মাসে সুন্দরবনের কাশিয়াবাদ স্টেশন থেকে ৩৬০টি নলীয়ান থেকে ৩১০টি বানিয়াখালী থেকে ২৫০টি কোবাদক থেকে ৩৫০টি (পাশ) নিয়ে জেলেরা সুন্দরবনে প্রবেশ করেছে। যেটা অন্য সময়ের তুলনায় অর্ধেকেরও কম।
স্থানীয় সামাজিক সংগঠনের নেতারা বলেন, বনদস্যু নির্মূলে যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ না করলে সাধারণ জেলে বাওয়ালীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রতিনিয়ত নির্যাতনে শিকার হচ্ছেন। তাদের নিরাপত্তার জন্য প্রশাসনিক ব্যবস্থা অত্যন্ত জরুরি।
এ বিষয়ে খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদ কালবেলাকে বলেন, ‘সুন্দরবনে জেলে অপহরণের ঘটনা শোনা যাচ্ছে, মাঝে মাঝে বনকর্মীদের সঙ্গেও বনদস্যুদের গোলাগুলি হচ্ছে। সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত করতে বন বিভাগের একার পক্ষে প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। বন বিভাগের সহযোগিতায় র্যাব, কোস্টগার্ড, বিজিবির অনন্য বাহিনীর সমন্বয়ে দ্রুত যৌথভাবে অভিযান শুরু করা হবে।’
মন্তব্য করুন